| | |

উপন্যাস “আনুর-নীলা”।


লেখকঃ- মোঃ রেজাউল করিম মৃধা।

সদ্য স্নানরত নীলা পুকুর থেকে স্নান( গোসল) সেরে কলসী কাঁখে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রাস্তায় আনুর হঠাৎ আচমকা চোখ পরে নীলার উপর, অবাগ দৃস্টিতে চেয়ে থাকে আনু। এ কি দেখছে? সে কি মানুষ? না পড়ি? নাকি হুর পড়ি? না কি জল পড়ি?

আহা! কি যে সুন্দর হারিয়েছি অন্তর,

ভাষা নেই, নেই ভাষা নেই।

আহা! কি সুন্দর? চোখ ফেরাতে পারেনা আনু।

ভিজে শরীরে নীলাকে অপূর্ব লাগছে।দেহের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ভিজে কাপড় লেগে আছে।

আনু অবাগ দৃস্টিতে নীলাকে দেখে!

আনুর সামনে এসে নীলা ও থমকে দাঁড়ায়।

নীলার ও চোখ পরে আনুর দিকে

প্রথম এমন একটি ছেলেকে দেখে নীলার বুক ধক করে উঠে।

আনুর দিকে চেয়ে আচমকা মুচকি হাঁসে।

লজ্জ্বায় লাল হয়ে দ্রুত চলে যায় বাড়ির দিকে।

আনু অবাগ দৃস্টিতে নীলার পথের দিকে চেয়ে থাকে আর বলে আহা! কি যে সুন্দর হারিয়েছি অন্তর,

ভাষা নেই, নেই ভাষা নেই।

প্রতিদিনের মতো আজো আনু বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলো পথে ভিজে শরীরে নীলাকে দেখার পর একটি মূহুর্তের জন্যও সুস্থ্য এবং স্বস্থির থাকতে পারছে না বারবার শুধু নীলাকেই মনে পড়ছে।

তখনও আনু জানেনা কে এই নীলা? কে এই অপরুপ সুন্দরী তন্নী।আনু রাতে ঘুমাতে পারে না। ঘুম আজ পালিয়ে গেছে। বারবার শুধু নীলার কথা মনে পরে। যে দিকেই তাকায় শুধু সদ্য স্নানত নীলা।

পরের দিন আনু বাজারের সেই রাস্তায় অপেক্ষমান কখন আসবে নীলা? একই গ্রামে বসবাস মাত্র কয়েকটি বাড়ির পর আনুর বাড়ি।তার পরও কে কার খবর রাখে? হিন্দু হোক মুসলমান হোক, ধনী হোক গরিব হোক আনুর এতো কিছু বুঝে না। শুধু ঐ কলসী কাঁখে স্নানরত সেই মেয়েটিকে প্রাণ ভরে দেখতে চায়।

জীবনে কত মেয়েইতো দেখেছে আনু কিন্তু নীলাকে দেখারপর আনুর মন এমন ছটফট করছে কেন?

কিসের এক মায়া জ্বাল? এ কেমন মনের টান?

এর উত্তর কেউ জানে না, শুধু আনু জানে তার অন্তর এখন শুধু ঐ মেয়েটি।

বসে থাকে রাস্তার ধারে পুকুর পাড়ে।

এক দিন নয় দু দিন নয়।

ঘন্টার পর ঘন্টা।

শুধু একটি নজর দেখার জন্য।

ঐ পুকুরটি হচ্ছে ইব্রাহিম পুর ভদ্র বাড়ির বিশাল পুকুর যা অন্য এলাকায় দ্বিতীয়টি নেই।বার মাস পানি থাকে। এই পুকুরটিতে প্রতিদিন কত শত মানুষ গোসল করে তার কোন হিসাব নেই।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আনুর মনের মানুষ নীলা কলসী কাঁখে গোসল করতে এবং পানি নিতে আসে। সাথে নিয়ে আসে ছোট বোন মিলুকে।

নীলাকে দেখেই আনন্দে আত্বহারা হয়ে উঠে। আনুর মন আনন্দে কাঁপতে থাকে। হাত পা অবস হয়ে আসে। কিছুই বলতে পারে না অবাগ দৃস্টিতে শুধু চেয়ে থাকে।

নীলা উচ্ছল মনে প্রতিদিনের মত আজো গোসল করতে আসে।আনুকে দেখেই গত দিনের কথা মনে পরে যায়।নীলা ও কিছু বলতে পারে না।তাড়াহুড়া করে গোসল করে বোনকে গোসল করিয়ে খালি কলস নিয়েই ভিজে শরীরে যেতে থাকে তখনো নীলার হাত পা কাঁপতে থাকে।

অনেক সাহস নিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে আনু নীলার কাছে এসে বলে “অপূর্ব”।

নীলার উত্তর নেই। শুধু তাকিয়ে থাকে।শুধুই তাকিয়ে থাকে। সেই মধুর চাহনি । আহ!

ছোট বোন হাত ধরে টান দে

নীলার জ্ঞান ফিরে।

নীলা চলে যায়

আনুর নীলা চলে যায়

আনু চেয়ে থাকে।

কেউ কিছুই বলতে পারে না।

শুধুই চেয়ে থাকে

মনে মনে সেই গানটি গেয়ে যায়।

চোখ যে মনের কথা বলে।

ইব্রাহিম পুর পোস্ট অফিস খুবই নাম করা। এখন এই পোস্ট অফিসের সামনে আনুর প্রতিদিন বসে থাকা।এই পোস্ট অফিসের তিন দিক দিয়ে অনেক গাছপালা সামনে রাস্তা। এই রাস্তাটি আজিম নগর বাজার থেকে কিম্বা স্কুল থেকে গ্রামের একমাত্র বড় রাস্তা অবশ্য এই রাস্তায় সবাইকেই যেতে হয় বিশেষ করে বর্ষা কালে । মাঠের ভিতর দিয়ে ও ছোট রাস্তা আছে কিন্তু এই রাস্তার পাশে পোস্ট অফিসের সাথে চালতা গাছ তলায় আনুর বসবাস।

প্রতিদিনই এই চালতা গাছতলায় বসে থাকে।

একদিন নয় দুদিন নয়

দিনের পর দিন।

অনেকে মনে করে আনু এই পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার।মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়ির চিঠিও আনু এনে দেয়। সেই সাথে অনেকের চিঠিপত্র আনু নিয়ে আসে।

কেউ জানেনা আনু এখানে কেনো বসে থাকে?

আনু নীলার জন্য হ্যা একমাত্র নীলার জন্য।

নীলার জন্য এভাবে প্রতিদিন অপেক্ষা করে।

নীলাকে এক নজর দেখার জন্য আনুর মন ছটফট করে। আর সে জন্য আনু নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে এখানে বসে থাকে।

আনু সাহস করে কাউকে কিছুই বলে না। শুধুই বসে থাকে। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর এক নজর দেখলেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।

কিছু দিন পর জানতে পারে নীলা গোপাল দপ্তরির মেয়ে।ইব্রাহিম ঈশ্বর চন্দ্র বহুমুখী হাই স্কুল অনেক নাম করা স্কুল। আমি ও এই স্কুলের ছাত্র।আমার ভাইবোন সবাই এই স্কুলে লেখাপড়া করেছি। দপ্তরি হোক আর পিয়নই হোক।

গোপাল দপ্তরিকে এক নামে সবাই চেনে।প্রতিদিন তার ঘন্টায় স্কুলের ক্লাস শুরু হয়, টিফিন হয় আবার স্কুল ক্লাস শেষ হয়। ছাত্র/ছাত্রী এবং শিক্ষক সবাই গোপাল দপ্তরির ঘন্টার অপেক্ষায় থাকে। কখন বাঁজবে সেই ঘন্টা?

তবে আনুর অন্তরে প্রতিটি মূহুর্তে নীলার প্রেমের ঘন্টা বেঁজে চলছে তার খবর কে রাখে? সেই ঘন্টা কেউ টের না পেলেও আনুর হ্রদয়ে প্রতিমূহুর্তে টকটক করে বেঁজেই চলছে।

নীলা বংশীয় ভাবে ছোট কিম্বা নিচু হলেও রুপে গুনে অপূর্ব। যে কোন বিশ্ব সুন্দরিকেও হার মানাবে। যদি আমাদের অজপাড়াগায়ে জন্ম না হয়ে শহরে কিম্বা অন্যদেশে জন্ম হলে সত্যিই বিশ্ব সুন্দর হতো। বাংলাদেশর যে কোন নায়িকাকে হার মানাবে।নীলা আসলেই অপূর্ব সুন্দরী যেমন শরীরে গঠন,চোখ, মূখ সব মিলিয়ে বিধাতার এক অপূর্ব সৃস্টি এই নীলা।

আনু ঢাকায় থাকে এই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে ঢাকায় গিয়ে লেখাপড়া না করে বড় বোনের ব্যাবসা প্রতিস্ঠানে কাজ করে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে।ছুটিতে বাড়িতে এসে হঠাৎ দেখা হয় নীলার সাথে। ঢাকা থেকে খবর এসেছে আনুকে ঢাকায় যেতে হবে।

নীলার সংগে কথা না বলে,

এক নজর ভালোভাবে দেখা না করে আনু কিছুতেই ঢাকায় যাবে না। আনুর অন্য কোন খেয়াল নেই। শুধু একটিই চিন্তা নীলা আর নীলা।

আনু পুকুর পারে অথবা চালতা তলায় কিম্বা পোস্ট অফিসের সামনে বসে থাকে। ঢাকায় থেকে খবর নিয়ে আসা বন্ধুটি বাসায় খবর নিয়ে দেখে বাসায় নেই।অবশ্য খবর পৌছে দিয়ে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো।

ঐ যে বললাম এই রাস্তা মেইন রাস্তা।

আনুকে দেখেই

কি রে আনু এখানে কি করছিস?

দেখছিস না বসে আছি।

আনুর এমন উত্তরে মর্মাহত হয়ে

সে চলে যায়।

শুধু বলে যায় তোর দুলাভাই তোকে ঢাকায় যেতে বলছে।

বন্ধু বান্ধব অনেকেই বলে

কি রে এখানে কি করছিস?

বসে আছি

বাড়ি যাবি না?

যাবো!

চল এক সাথে যাই।

তুই যা আমি পরে আসছি।

বাড়িতে ঠিকমত যায় না, সময় মত খাওয়া দাওয়া করে না

আনু বেশীর ভাগ সময় নীলার বাড়ির সামনেই বসে থাকে।কখনো পুকুর পাড়ে , রাস্তার ধারে কিম্বা পোস্ট অফিসে কখন বা রাস্তার ধারে পায়চারি করে শুধু কখন এক নজর দেখতে পাবে নীলাকে?

কথায় আছে যার সাথে যার ভাব আছে তার পাছা দেখলেও লাভ আছে।

নীলাকে যে টুকু দেখতে পায় সেই টুকুই আনুর মহা আনন্দের মহ শান্তির।

নীলাদের বাড়ির পাশেই নিতাই চকিদারের বাড়ি।নিতাই চকিদার। রাতে গ্রাম পাহাড় দেয়।ডিউটি করার পর আবার বাড়িতে টানা, বাদাম, নিমকি,সিগারেট, বিড়ি বিক্রি করে অনেক খাবার বাড়িতে তৈরি হয়। সেই সব খাবারের জিনিস গুলি আজিমনগর বাজারের ফুটপাতে খালি জায়গায় বিক্রি করে এবং বাড়িতে ও তার স্ত্রী ছেলে মেয়েরা বিক্রি করে।বউ,ঝি,গিন্নী সকলেই খাবার জিনিস তৈরি করতে এবং বিক্রি করতে সাহায্য করে।নিতাইর ঝাল চানাচুর এলাকার সবার সুপরিচিত।

নিতাই চকিদারের বাড়ি এখন আনুর প্রতি দিন প্রতি মূহুর্তে যাতায়াত। কখনো বিডির জন্য, কখনো সিগারেট বা ঝাল চানাচুর কেনা ছলে। যেতে আসতে যদি একবার নীলার দেখা মিলে।

আনুর মুখে এখন একটিই গান

ও প্রাণ সজনী, কাঁটেনা দিন রজনী,

তুমি আমার পূর্নিমাসের চাঁন।

তুমি ছাড়া বাঁচে না এ প্রাণ।

দিনে রাতে কতবার যে আনু নিতাই চকিদারের বাড়ি যায় তার খবর নেই। কতনা ছলনা করে নীলাকে এক নজর দেখার জন্য।এক নজর দেখলেই আনুর মনে কিছুটা শান্তি ফিরে আসে।

নীলাদের বাড়ির ডান পাশে কয়েকটি বাঁশ ঝারের পর সোবহান সাহেবের বাড়ি। সোবহান সাহেব ও ঢাকায় থাকেন। বাড়িতে তার স্ত্রী মেয়ে এবং ছেলে থাকে। ছেলে মেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করে। আনন্দেই সংসার পার করছেন সোবহান সাহেব এ তার পরিবার। ঈদে এবং ছুটিতে বাড়ি বাড়ি আসে তখন আনন্দ আরো বহু গুনে বেড়ে যায়।

আনু হঠাৎ বুদ্ধি করে এখন সোবহান সাহেবের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে।

গলায় কাঁশি দিয়ে সোবহান সাহেবের বাড়িতে প্রবেশ করে। ভাবী কেমন আছেন?

ভালো!

ভাইর খবর কি?

তিনি ভালো আছেন!

আপনার কি খবর?

প্রশ্ন করতেই আনু থমকে যায়!

যদিও বলে ভালো আছি!

আনু কি সত্যি ভালো আছে?

প্রতিদিন সোবহান সাহেবের বাড়িতে যাতায়াতের ফলে বউ বাচ্চাদের সাথে আনুর একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে। এছাড়া আনু ঢাকায় চাকরি করে সোবহান সাহেব ও ঢাকায় থাকেন এ কারনে আনুকে আরো আপন করে নেয় সোবহান সাহেবের পরিবার।

সোবহান সাহেবের বাড়ি আনুর এখন নিয়মিত যাতায়াত।যতক্ষন পোস্ট অফিস খোলা থাকে ততক্ষন আনুর আড্ডা পোস্ট অফিসে এর পর পুকুর পারে পোস্ট অফিস বন্ধ হলে আনুর আড্ডা সোবহান সাহেবের বাড়িতে।

তখনো নীলা জানেনা। আনু শুধু তার জন্যই এতসব করছে। আনুকে নীলার ভালো লাগলেও জীবন সংগী হবে সেটা কখনো ভাবে নাই।নীলা জানে সে হিন্দু পরিবারের এক নিচু বংশের মেয়ে।আর আনু হচ্ছে খা বাড়ির ছেলে ।

আনুর পুরা নাম আনোয়ার হোসেন খান ডাক নাম আনু বা আদর করে আনু বলে সবাই ডাকে। বাবা শাহাদত হোসেন খান। রেংগুনে চাকরি করতেন। অনেক জমিজমা কিনেছেন।গ্রামে খুবই নাম করা বেশ সম্পদের অধিকারী। ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে অর্থাৎ আনুরা ৭ ভাইবোন। আনু হচ্ছে ভাইবোনদের মধ্যে ৪র্থ এবং ভাইদের মধ্য তৃতীয়। তবে ভাইবোনদের সবার কাছে বেশী প্রিয়।

ছেলেদের চেয়ে উপস্থিত বুদ্ধিতে মেয়েরা এগিয়ে। খোঁজ খবর নেওয়ার বেলায় মেয়েরা অতি দ্রুত খবর নিতে পারে।আনু খবর নিয়েছে নীলা । খা বাড়ির ছেলে একজন মুসলমান তাই আনুকে এডিয়ে চলে নীলা।

কিন্তু আনু নাছর বান্দা,

নীলার পিছু নিয়েছে তো নিয়েছে।

অন্য কিছু জানেনা আনু,

কিছুই জানতে চায় না।

বাড়ির কেউ তখনো এত কিছু জানেনা।

দেখে আনু সিগারেট বা চানাচুর কিন্তে নিতাইর বাড়ি যায় না হয় খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সোবহান সাহেবের বাড়ি যায়। অথবা নীলার বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করে।

কেউ কখনো কল্পনা করতে পারে না নীলাকে ভালো বাসবে আনু। মুসলমান ছেলে হিন্দু মেয়েকে ভালো বাসবে। এটা কি করে সম্ভব? ধর্মেই কি বলে?

তাও আবার এক তরফা।

নীলা আনুকে ভালোবাসে কিনা?

সে প্রশ্ন করার সময় নাই আনু।

শুধু ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা।

আনু এত কিছু বুঝে না। শুধু বুঝে নীলা আর নীলা।

সোবহান সাহেবের বউ এর নিকট আনু তার মনের কথা বলে।

বলে ভাবী নীলার সাথে আমাকে দেখা করার ব্যাবস্থা করে দাও।

ভাবী বলে,” সেকি তুমি নীলাকে ভালবেসেছ?

আকাশ থেকে পরে ভাবী।

তাতেও আনুর বিন্দুমাত্র ভূরুক্ষেপ নেই।

পিছনে ফিরে না আনু।

কি যে মায়ার টান নীলার সাথে তা কি করে বুঝাবে আনু!

ভাবী অনেক বুঝায় আনুকে

বলে

আপনি খান বাড়ির সন্তান।

আপনার বাবার অনেক নাম ডাক।

আর এ হচ্ছে নীলা একজন সামান্য দপ্তরির মেয়ে। হিন্দদের মধ্যে সবচেয়ে নিচু বংশের মেয়ে। আপনি কি করে তাকে ভালোবাসবেন?

এ হয় না,হতে পারে না।

আপনি মুসলমান আর ও হিন্দু।

এ বিষয়টি কেউ মেনে নেবে না।

আনু এখন কারো কোন যুক্তি মানতে রাজি নয়।

শুধু নীলাকে চাই, সে যে বংশের হোক, যে ধর্মের হোক, শুধু নীলাকে চাই।

নীলা যে অপূর্ব সুন্দরী এটা ভাবী কেন? কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।তারপর উঠনতো বয়স। এ বয়সে সব কিছুই ভালো লাগে।নীলা অবশ্যই ভালো লাগার মতো মেয়ে।

আনু ভাবীকে বলে

এক মূহুর্তে জন্য হলেও আমি নীলাকে সামনে সামনে দেখতে চাই।

ফেইজ টু ফেইজ।

আপনি আমাকে সাহায্য করেন।

আনুর আবেগ আপ্লুত অনুরোধ ফেলতে পারে না ভাবী।

ভাবী বলেন “দেখি কি করতে পারি”

আনু সে দিনের মতো বাড়ি ফিরে যায়।

যাবার সময় নীলার বাড়ির সামনে দিয়ে সেই গান ধরে

ও প্রাণ সজনী কাটে না দিন রজনী।

প্রতিদিন কতজনই এই রাস্তা দিয়ে যায়, গান গায়, তার হিসেব কে রাখে?

কিন্তু আনুর খবর কেউ না রাখলে ও নীলা ঠিকই রাখে নীলা বুঝতে পারে আনু তার জন্যই এ গান গাইতেছে।এ গানের সুর তাল লয় ঠিক না হলেও নীলার অন্তরে ঠিকই ঠাঁই পেয়েছে।

এ ভাবেই চলে দিনের পর দিন।পুকুর পাড়ে অপেক্ষার পর অপেক্ষা।

নীলা তার কখন আসে

কখন আসে।

কখন আসবে নীলা?

স্নান করবে, ভিজে কাপড়ে হেঁটে যাবে। ভিজে কাপড়ে অপূর্ব নীলা। শরীরের প্রতিটি ভাজে ভাজে নৈশ্বর্গীয় চেতনা।

সেই ভিজে কাপড়ে দেখার প্রতিক্ষায় অপেক্ষমান।

প্রতিক্ষার প্রহর গুনছে।

কখন আসে? কখন আসে?

দুপুরে স্নান শেষে ভিজে কাপড়ে বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আনু।নীলার চলে যাওয়া পর্যন্ত আনু পথ পানে চেয়ে থাকে।

পরে না চোখের পলক

এ কেমন মনের ঝলক।

চলে গেছে অনেক দিন

দু একটি কথা একটু চোখা চুখি

এই টুকুই আনুর অনেক পাওয়া।

কি যে ভালোলাগে আনুর।

নীলার যে ভালো লাগে না, তাই কি হয়।

নীলার ও ভালো লাগে আনুকে দেখলে।

এত দিন পর একটি মানুষ নীলার জন্য অপেক্ষা করছে এইটাই কম কিসের।

আনু বাড়ি যেয়ে এক মূহুর্ত ও থাকতে পারে না। কোন রকম খাওয়া দাওয়া করেই চলে আসে সোবহান সাহেবের বাড়ি।

ভাবী কি করলে আমার জন্য?

অপেক্ষা করেন , সবুরে মেওয়া ফলে।

আর তো পারি না ।

সত্যি আনু আর পারে না ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে।

তুমি বাড়ি যাও

দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি।

অনেকটা স্বস্থি নিয়ে বাড়ি ফিরলে ও কিছুই ভালো লাগে না আনুর, মন ছটফট করে।

মা এবার ধরে বসলো।

মা কে সবাই মানে

শুধু আনু নয় পরিবারের সবাই । বাবার অবর্তমান মা ই সব এবং তিনি অত্যান্ত বুদ্ধিমতি। তার বুদ্ধির প্রসংশা সবাই করে। এলাকার অনেক সমস্যা সমাধানে তিনি এগিয়ে আসেন। এছাড়া তার বাড়িতে সব সবময় লোকের আনাগোনা থাকে। বিশাল বাড়ি অনেক বাগান আছে এছাড়া মাঠে অনেক জমি আছে। সব কিছুকেই তিনি শক্ত হাতে টেকেল দেন।

মার কথার উপর কথা বলার সাহস বা স্পর্ধা আনুর নেই।

তুই এখানে এতদিন কেন?

আনু নিরুত্তর

ঢাকায় তোর এতবড় দায়িত্ব

জাহানারার জামাই খবর দিয়েছে

তোকে ঢাকায় যেতে হবে।

জাহানরা হচ্ছে আনুর বড় বোন।

বোনের জামাই খুব বড় ব্যাবসায়ী।

পুরান ঢাকার জিন্দাবাহারে কাগজের ব্যাবসা।ঈদে অথবা যেকোন সময় শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে এলে এলাকায় একটি হিড়িক পরে যায়।

খা বাড়ির বড় জামাই আসছে।

বাজার থেকে বড় মাছ কেনা সহ বাজার করার বেশ ধূম পরে যায়।

দেখতে খুবই সুন্দর

বিদেশী বলে মনে হয়।

স্কুল শেষে বিকেলে খেলতে গেলে বন্ধুদের সাথে আমাদের দুলাভাইকে দেখতে যেতাম।

কাকী আমাকে এমনি আদর করতেন।

মৃধা বাড়ির ছোট ছেলে। গ্রামের সবার আদর আমার জন্য জমা থাকে। যে দিনের যে ফল আমার জন্য সংরক্ষিত থাকতে আনুদের বাড়ি গেলেই আমাকে খেতে দিতো।

দুলাভাই মাটিতে বসে খেতে পারতেন না।

তখন হয়তো বুঝি নাই এখন বুঝি।

মানুষ অভ্যাসের দাস। তখন আমরা গ্রামের বেশীর ভাগ বাড়িতেই মাটিতে পাটি বিছিয়ে খেতো। আর মেহমান এসে পাটির উপর চাদর বিছিয়ে দিতো। নতুন আত্বীয় হলে ছতরন্জি আর একটি চমক থাকতো।

দুলাভাই মাটিতে পাটি বিছিয়ে সবার সাথে খাবার দিলে তার সামনে ছোট্ট জল চকি গ্রামের ভাষা ছোট্ট টুলের উপর রেখে তিনি খেতেন।ঢাকায় চেয়ার টেবিলে খাওয়ার অভ্যাস।

ধীরে ধীরে গ্রামেও চেয়ার টেবিলে হয়েছে।

দুলাভাই বাড়িতে এলে আমরা যেতাম।জাহানরা আপা আমাকে ঢাকা থেকে আনা চকলেট দিতো আর আমাদের বাড়ির সবার খোঁজ খবর নিতো।

বিশেষ করে আমার বড় বোনের কেননা আমার বড় বোনের নাম ও জাহানরা ছোট কালে দুজনে বান্ধবী ছিলেন। এখন দুজনেরই বিয়ে হয়েছে। দীর্ঘ দিন কারো সাথে দেখা নেই।

বোনের ব্যাবসা দেখার পুরো দায়িত্বই আনুর।

আনু বলে দু একদিনের মধ্যেই যাবো।

নীলার সাথে দেখা না করে নিভৃত্বে একান্ত স্বাক্ষাত না করে কিছুতে যেতে পারছে না আনু।আনুর মন কিছুতেই তর বা দেড়ী সহ্য হয়না।

সোজা চলে আসে ভাবীর কাছে।

বলে আমার জন্য তো তুমি কিছুই করলে না।২/১ দিনের মধ্যে আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে।

ভাবী বলে তুমি বস আমি আসছি।

ভাবী একটু সেঁজে গুঁজে নীলাদের বাড়ি যায়। প্রয়োজন ছাড়া অন্য বাড়িতে যাওয়া সত্যিই লজ্জার ব্যাপার। যদিও প্রতিবেশী তারপর হিন্দু।

অন্য ধর্মের মানুষ। যাতায়াত খুবই কম। নেই বললেই চলে তারপর প্রয়োজনে মানুষ কি না করেন?

আনুর খাতিরে নতুন করে যাতায়াত শুরু করে সোবহানের বউ।

সোবহানের বউ নীলাদের বাড়ি যায়।

কেমন আছে খবর নেয়।

সোবহানের বউ বাচ্চাদের আদর করে বসতে দেয়।

নীলার মা বলেন “ কি গো বউ তুমিতো আমাদের বাড়িতে আস না।

ভাবী বলেন সময় কই? বাচ্চাদের সামলাতে পারি না।আসবো অবশ্যই আসবো

এই তো এলাম।

এবার নীলার দিকে তাকিয়ে

নীলা তুমিতো আমাদের বাড়িতে আসই না।

নীলা বলে আসবো বউদি

আমাদের এলাকার হিন্দুর ভাবীকে বউদি বলে ডাকে।

ভাবী নীলাকে তাদের বাড়ি যেতে বলে।

সেদিনের মত চলে যায় সোবহানের বউ।

এরপর নিতাই বাবুর বাড়ি যেয়ে কিছু ঝাল চানাচুর নিয়ে আসে।

ভাবীকে দেখেই আনন্দে আত্বহারা হয়ে উঠে আনু।এক লাফ দিয়ে ভাবীর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করে

ভাবী কি খবর?

ভাবী বলে এতো অস্থির হওয়ার কিছু নাই। ২/১ দিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ি আসবে।

২/১ দিন আনুর জন্য অনেক।এক একটি দিন আনুর কাছে যুগ যুগ থেকে অনেক বেশী।

কাল থেকে কালান্তর আনুর আর সহ্য হয়না।

আনু আবেগ নিয়ে বলে

নীলাকে কেমন দেখলে?

আমার কথা কিছু বলেছে?

ভাবীর সোজা উত্তর নাহ!

সময় পেলাম কই?

আনুর মন খারাপ হয়ে যায়।ভাবী বলে ২/১ দিনের মধ্যেই তোমার সাথে দেখা করবে।

ভাবী তুমি বুঝতেছনা ২/১ দিনের মধ্যে আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার আগেই তোমার সাথে দেখা হবে।সেই সময় স্বস্থির নিশ্বাস নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় আনু।

কাটেনা সময় যখন আর কিছুতেই।

আনুর ধ্যান, জ্ঞান শুধুই নীলা।

আনুর যে ঢাকায় যেতেই হবে।

মা বকাঝকা শুরু করে।

তুই ঢাকায় না গেলে ওদের বলে দে ওরা অন্য কর্মচারি রেখে নিবে।তোর জন্য তো তাদের ব্যাবসা নস্ট করতে পারি না।

তোর যা খুশি তাই কর। কিন্তু জাহানারার কোন ক্ষতি করতে পারবি না।

আনু সব বুঝে,

কিন্তু কিছুই করার নেই।

আনু এখন ত্রিমূখি দ্বন্দে।

একদিকে বোনের ব্যাবসা বা নিজের চাকরি,

অন্য দিকে মায়ের বকাঝকা,

অপর দিকে দিয়েছে মন।

ত্রিমূখী যন্ত্রনায়

কি করবে আনু?

(চলবে)


Similar Posts