ছোট্ট বেলার ঈদ সালামী
মো: রেজাউল করিম মৃধা
ছোট্ট বেলার
ছোট ছোট আশা
একটু খানী উপহারে
ভাঁসে আনন্দের বন্যা।
ছোট্ট বেলার সামান্য উপহারের স্মৃতি, বহে সমান তরাল।
সত্যি তাই ছোট্ট বেলার সেইসব স্মৃতি মনে হলে, মনে হয় এই সে দিন অথচ নদীতে পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। কেটে গেছে বহু সময়।কিন্তু মনে পরে ক্ষমে ক্ষনে। ঈদের দিনের সেই সব স্মৃতি কতই না মধুর ছিল।হয়তো আপনাদের অনেকের মনে আছে সেই সব ছোট্ট বেলার স্মৃতি গুলি।
গ্রামের বাড়ী সামনে খোলা মাঠ ধান ক্ষেত সারি বদ্ধ বাড়ী গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সারি সারি গাছ পালা আম,কাঁঠাল, সুপারি,পাতাবি লেবুর মৌ মৌ গন্ধ প্রান জুড়িয়ে যায়। শীতের সময় খেজুর গাছের রস কতনা মিস্টি। এখনো হয়তো আছে কিন্তু খেতে পারিনা। ইচ্ছে করলেও সম্ভব হয়ে উঠেনা।ছুটিতে দেশে গেলেও হয়তো শীতের মৌসুম হবে না আবার হলে ও রস খেতে গেলে গ্রাম কে গ্রাম রস খুঁজে পাওয়া ভাড় আর পেলে ও গাছি ভাই বলবেন আগের মত আর নেই।
কি নেই? কি নেই? কেনো নেই? তার উত্তর মেলা ভার। সবই তো আছে, সেই গ্রাম , সেই পথ, সেই গাছ। হয়তো এত বছরে গাছ গুলি মোটা হয়েছে অথবা কাঁচা রাস্তা গুলি কোনমতে পাঁকা হয়েছে অথবা খালের ধারে পুকুর পারে রাস্তা এতটাই সুরু একটু হলেই সোঁজা পানিতে হাবুডুবু ক্ষেতে হবে।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যে খানে গ্রামে কোন ফোন এটাতো কল্পনার বাহিরে ছিলো অথচ আজ সেখানে হাতে হাতে মোবাইল। এর সাথে সাথে কতই না পরিবর্তন আমার মনে হয় সব চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে আমাদের মানুষিকতার।মায়া ,মমতা , মহব্বত,এখন যান্ত্রিক পরিনত হয়েছে।হয়তো আগের মত শ্রোদ্ধাবোধ ও নেই।মুরুব্বিদের দেখলে ছালাম করার কথা ভুলে গেছি।এখন মুরুব্বিদের দেখলে ছালাম দেওয়ার ভয়ে অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আর মুরুব্বিরা ও মাথা নিচু করে হেঁটে যায়।অথচ আগে মুরুব্বি অথবা শিক্ষক দের দেখলে ছালাম করা হোত। সেই শ্রোদ্ধাবোধ নাই বললেই চলে।
যে কথা বলছিলাম ছোটবেলার ঈদ ছালামী বা ঈদের বকশিস ।আপনাদের ও হয়তো মনে আছে । মনে পরে ছোট বেলার কত শত স্মৃতি।যদি শীতের সময় হতো তা হলে তো আনন্দ আরো বেশী। আমাদের পুকুর পারে সূর্যের তাপের জন্য রোদ পোহাতাম আর আশেপাশের আমার সম বয়সী বন্ধুরা ও আসতো এক এক করে। তখন কে কার আগে ঝাঁপ দিয়ে গোসল করতে নামবে সে প্রতিযোগিতা থাকতো। পুকুর পাড়ে রোদ পোহাতে বেশ মজাই লাগতো। তবে যে সবার আগে নামবে সে অন্য সবাইকে পানি, ছিটিয়ে অন্য সবাইকে ভিজিয়ে দিবে।সাথ সাথে সবাই হই হুল্লোড় করে লাফিয়ে পুকুরে গোসল করতে নামার সেই আনন্দ কখনো ভূলা যায় না। তার পর চলতো সাঁতারের পাল্লা। আমার বড় বোন জাহানারা বেগম। বড় বুজি বলে ডাকতাম এখন ও ডাকি। বড় বুজি নতুন কাপড় ও খাঁটি সরিষার তেল নিয়ে হাজির। মা ততক্ষনে রান্না নিয়ে ব্যস্ত।আমরা ব্যস্ত সাঁতার নিয়ে । বুজির ডাকাডাকিতে বাধ্য হয়ে উঠতে হতো।হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে আমি উঠার সাথে সাথে শরীর মুছিয়ে তেল দেওয়ার পর নতুন কাপড় পরার সেই আনন্দ আজ শুধুই স্মৃতি।
এরপর গরম গরম খিচুরী , পায়েস খেয়ে নতুন কাগজের রংগীন টুপি পরে বন্ধুদের সাথে দৌড়ে ঈদ গাহ এর দিকে যাওয়া । সেই যে দৌড়, সেই দৌড় আজ পর্যন্ত থামেনি । গ্রাম থেকে শহর , শহর থেকে ,দেশ ছেড়ে প্রবাসে । ফ্রান্স থেকে ইতালী। ইতালী থেকে ইংল্যান্ড । আমার প্রানের শহর ঢাকা থেকে স্বপ্নের শহর লন্ডন। বিলেত নামে খ্যাত। সেই বিলেতে ও খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়ি। কিন্তু সেই আনন্দটাই শুধু নেই।
নতুন জামা গায়ে মাকে ছালাম করি। মায়ের দোওয়া নিয়ে নামাজ পড়তে যাই। মায়ের দোওয়া সব সময়ই আছে। যদিও মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।এর পর সেঝ কারা, ছোট কাকা এবং অন্যান্য মুরুব্বীদের । ছালাম করলেই পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করে আমাকে দিত। আমি একা নই আমার সাথে ২/৩ জন বন্ধু নুরুল ইসলাম, সেলিম, মনির,ফরহাদ, হারুন ভাই সহ আরো অনেকে। ওরা বলতো আমার সাথে থাকলে ছালামী বেশী পাওয়া যায়।ছোট বেলা থেকেই মুরুব্বীরী আমাকে বেশী আদর করতেন এখন ও করেন তবে বয়সের সাথে সাথে আদরের রয়েছে অনেক পার্থক্য ।
যে ঈদে মিয়া ভাই দেশে আসতেন , সে ঈদে আমার আনন্দ হাজার গুন বেরে যেতো। আমাদের পরিবারের সবার বড় ভাইকে আমরা মিয়া ভাই বলে ডাকি। সব ঈদে গ্রামের বাড়িতে আসতেন না ছুটির জন্য। আর্মীতে চাকুরি করতেন।সেনাবাহিনীর অনারাবল ক্যাপ্টন হয়ে রিটায়াট করেছেন।কিন্তু তিনি স্বপরিবারে দেশের বাড়ী বা গ্রামে এলে সবাই সবাই বেশ সমাদর করতো। আর আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের জন্য সোনায় সোহাগা। যখন জানতাম মিয়া ভাই দেশে আসবেন আমাদের মনের মধ্যে আন্দোলিত হতো শুধু আমি নই বাড়ীর সবাই। আগে তো ফোন ছিল না, চিঠি লিখতেন। চিঠি লিখে জানাতেন।পিয়ন এলেই বুঝা যেতো অবশ্যই ভালো কোন খবর আছে।মিয়া ভাইর চিঠি ঈদে বাড়ী আসবেন,কি যে আনন্দ?
আমাদের পরিবারের সাথে অন্যরাও আনন্দিত হতো বিশেষ করে আমার বন্ধুরা এবার নতুন টাকা একেবারে নতুন ব্যাংক থেকে তোলা। পিন লাগানো। ঈদের দিন বান্ডিল থেকে সবাইকে বকশিস দিতেন। সেই নতুন টাকার গন্ধ অন্য রকম আনন্দ।সবার আগে আমাকে। আমি ছালাম করতাম বন্ধুরা সবাই পিছনে পিছনে লাইনে।মিয়া ভাই আর কারো জন্য কিছু আনুক আর না আনুক আমার জন্য ঈদে নতুন জামা আনবেনই।বকশিস নিয়ে আমরা বন্ধুরা ঈদের মাঠে যেতাম মরুব্বী যাদের পেতাম সবাইকেই ছালাম করতাম সবাই ছালামী দিতেন। দুলাভাই , চাচা তো দুলা ভাই ঈদে বেড়াতে এলে ছালাম করলে আমাকে বকশিস দিতেন।আমরা বন্ধুরা মিলে পাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে যেতাম সবার সাথে দেখা হতো আর ঈদের সিন্নী খিঁচুরী পায়েস খেতাম। সেই দিন গুলি আর কি ফিরে পাওয়া যায়?
ঈদের পর দিন আসতেন আমার মামা। হাতে মামীর হাতে বানানো পিঠে পায়েস। বেচারী শীতের দিনেও ঘেঁমে যেতেন। তখন তো এতো গাড়ী ছিল না তাই হেঁটে হেঁটে আসতে হতো । হাতে খাবারের প্যাকেট অনেকটা পথ। দূর থেকে মামাকে দেখলেই মা কে বলতাম মামা আসতেছেন। মা এর মুখে আনন্দের হাসি ফুঁটে উঠতো আর আমি দৌড়ে গিয়ে মামাকে এগিয়ে নিয়ে আসতাম। মামাকে বসতে দিতাম আর বড় বুজি হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতো। আমি মামা কে ছালাম করতাম মামা পকেট থেকে টাকা দিতেন। মা অবশ্য বলতে টাকা দিতে হবে না। মামা বলতেন এটা ঈদের ছালামী তুই কিছু বলিস না। মামা মার বড় ছিলেন । তাই মারে তুই করে বলতেন।এখন মা এবং মামা আমাদের মাঝে নেই । আছেন মিয়া ভাই। কত বছর পেরিয়ে গেছে । মিয়া ভাইর সাথে এক সাথে , এক সাথে ঈদের নামাজ পড়া হয় না। ঈদের সেই ছালামী ও পাইনা।
বন্ধুরা ও সবাই আছে। এক এক জন এক এক জায়গায়।দেশে গেলেও সবার সাথে দেখা হয়ে উঠে না।এক এক জনের সংসার হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে ভালই আছে।তবে নেই সেই দিন গুলির মত আনন্দ।তবুও স্মৃতি গুলি মধুময়।ঈদ মোবারক।