করোনা এবং আমার যাপিত জীবন। (পর্ব-৫)

Corona Diary

করোনাভাইরাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, আত্মবিশ্বাস, সহীনশীলতা, ধৈর্য এবং শোক কে শক্তিতে পরিনত করে নিজেকে ঘুরে দাঁড়াতে।
এ করোনাভাইরাস আমাদের শিক্ষা দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জনের। এ অভিজ্ঞতা গুলি মেনে নিতে খুবই কস্ট দায়ক।

একজন ইমাম, খতিব, মসজিদের ট্রাস্টি, ইসলামী স্কলার,চ্যানেল এস এর ইসলাম এসেন্সিয়ালস এর প্রেজেন্টার এবং ফান্ডরাইজিং প্রেজেন্টার,আমার একজন শ্রোদ্ধেয় মানুষ , শুধু আমার নয় আমাদের সবার প্রিয় মানুষ আবু সাঈদ আনসারী।

দীর্ঘ দিন ধরেই চ্যানেল এস এ আসছেন না। কারন কি? প্রথম শরীর অসুস্থ তাই আসেন না কিন্তু শুধু শরীর অসুস্থ নয় তিনি কভিড ১৯ করোনাভাইরসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পান্জা লড়ছেন দীর্ঘ সময় ধরে।

১ লা এপ্রিল ২০২০ তিনি চরম ভাবে করোনার আলামত গুলি অনুভব করতে থাকেন।শরীর কাঁপানো জ্বর, কাঁশি, শ্বাস কস্ট, অক্সিজেন লেভেল একে বারে লো। মৃত্যুর খুবই কাছাকাছি। যেকোন সময় চলে যেতে পারেন এমনই অবস্থা কিন্তু মানুষিক ভাবে তিনি অনেক শক্ত। আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস, এমনিতেই দোয়া দরুদ পড়েন সবসময় এখন পরিমাণে আরো বাড়িয়ে দিলেন। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন উপায় নেই । সেই সময় ব্রিটেনে করোনা মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। হতাশ না হয়ে ন্যাচারাল মেডিসিন গ্রহন শুরু করেন। কালোজিরা, কালোজিরার ভর্তা এবিএম তার তেল, মধু, সরিষার তেল,জমজমের পানি, আজোয়া খেজুর , লেবুর সরবত এবং গরম পানির ভাপ।

কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছেনা। দিন দিন অবস্থা আরো অবনতির দিকে। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন শরীরে অবনতি হচ্ছে । পরের সপ্তাহে পা ফুলে গেল। এবং ব্যথা বেড়ে গেলো। এখন মরার উপর খাড়ার ঘা। ভয় আরো বেড়ে গেলো। ডাক্তারের ফোন করলে বললেন, ‘ ভাইরাস চরম আকার ধারন করেছে”।

তিনি বলেন,” শরীরে ঝাঁকুনি শুরু হয়।প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভব করি। মনে হয় পুরা বডি ক্লাপস করছে”।

‘’১১১ ফোন করলেন, ওরা এম্বুলেন্স পাঠালো। হাসপাতালে নিতে চায় কিন্তু আমি যাই নাই”। কারন “আমার শাশুড়ী এই হাসপাতালেই মারা গেছেন”।
“ শাশুড়ী মৃত্যুর পর তাকে জানাজা আমি পড়াতে পারি নাই। কবরে এক মুঠো মাটি দিতে পারি নাই”
এটা যে কত বড় কস্ট একমাত্র তিনিই জানেন। অথচ একজন ইমাম ও খতিব হিসেবে অন্য মানুষের জানাজা পড়ান আর আজ নিজের আপন জনের জানাজা পড়াতে না পারার দু:খ এবং কস্ট সত্যি বেদনা দায়ক। আর এ কারনেই তিনি হাসপাতালে থাকতে চাননি। তিনি মনে করেন ”করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর জন্য হাসপাতালের চেয়ে বাসাই নিরাপদ, যদিও এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।’’

এ ভাবেই চলে অনেক দিন, দিন যায় অবনতি হয় তবুও বাঁচার আশা ছেড়ে দেননি।আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ন্যাচারাল এবং প্রফেটিক মেডিসিন ব্যবহার করে যাচ্ছেন।তিনি আইসোলেসনে ছিলেন। পরিবারের সবার সাথে সামাজিক দূরত্ব রেখে থাকতেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সবাই সামাজিক দূরুত্ব রেখেই তার সেব করে যাচ্ছেন। একা এক রুমে । দরজার সামনে আসলেও কই রুমে ডুকতোনা।
তার ছোট্ট মেয়ে কাছে আসতে চাইতো, মাকে বলতো ‘কই আমি তো বাবার মাঝে ভাইরাস দেখি না,’ দূর থেকে ইশারায় আদর আর মায়া দিতো। বাবা হিসেবে ইমাম আনসারী খুব কষ্ট পেতেন। অনেক দিন বাচছাদেরকে তিনি জড়িয়ে ধরতে পারেন নি।

কিন্তু অবস্থা আরো অবনতি নিজের জিপি কে ফোন করলে ২২ শে এপ্রিল ২০২০ এপোয়েন্টমেন্ট দেন।
বললেন মজার ব্যাপার । ডাক্তার বললেন তার জন্য দুটি অপশন :
১/ হাসপাতাল
২/ কমিউনিটি হাব ক্লিনিক।
তিনি বললেন,”আমি দ্বিতীয় টি গ্রহন করি।”

পুরো ক্লিনিকে একমাত্র তিনিই রোগী । অন্য কোন রোগী নেই তবে “আমার জন্য নিবেদিত ডাক্তার, নার্স সহ অন্যান্যরা”।আজ যেন অন্য এক অভিজ্ঞতা। সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে ঐ সময়টাতে। তার জন্যই সব আয়োজন।তাকে সবাই দূর থেকে দেখছে কেউ যেন কাছে আসছেন না। রুমে নেওয়া হলো নার্স ২ মিটার দূরে ডাক্তার দূরে আমার কথা শুনছেন। সকল বিষয় জানলেন।
পরে ডাক্তার বললেন,”তোমার লাং ইনফেকশন হয়ে গেছে”।এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও আছে। সান্তনা হিসেবে ঔষধ দিলেন এন্টিবায়োটিক।সময় দিলেন মাত্র ২৪ ঘন্টা,
বললেন” ঔষধ নিয়মিত খান, আর আল্লাহ কে ডাকেন, আল্লাহ ভালো জানেন”।
তখনকার মনের অবস্থা ঠিক বুঝে নিতে হবে। নার্স , আত্বীয় স্বজন সবাই জানে। আমার আর বেঁচে থাকা হবে না। শাশুড়ীর কবরে মাটি না দিতে পারলেও তার পাশের কবরে শায়িত হবেন।

কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? যদি হায়াৎ থাকে তবে আল্লাহ রক্ষা করেন।সেই ২৪ ঘন্টা যেন আর শেষ না হয়।হোক ,দিন ,মাস ,বছর, যুগের পর যুগ। বেঁচে থাকুন বহু বছর।
তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন এবং দোয়া চাচ্ছে। সবাই আমরা আবু সাঈদ আনসারী ভাইর জন্য দোয়া করি। আল্লাহ যেনো পরিপূর্ণ সুস্থ করে তাকে দীর্ঘ নেক হায়াৎ দান করেন। আমিন।


Similar Posts