করোনা ও আমার যাপিত জীবন। (পর্ব-২)
অনেক সময় চ্যানেল এস এর এম ডি তাজ চৌধুরী মাওলানা সাঈদ সাহেব কে অফিসে নিয়ে আসার কথা বলেন। বলেন কল সেন্টারে লোক আনার কথা। তবে চ্যানেল এস এর ফাউন্ডার মাহি ফেরদৌস জলিল, আমাকে সরাসরি কনো কাজে অর্ডার করেন না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মহামারিতে তিনি একদিন ফোন করে বললেন।” পান আনতে হবে, আমার জন্য কিছু পান নিয়ে আসেন”। সকাল ৯টা কি সারে ৯টা হবে।এবার পরলাম মহা দু:স্চিন্তায়। কখনোতো কিছু বলেননি এটা লাগবে। ঐটা লাগবে।
কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে নাজিম ভাই বলেন। নাজিম ভাই আমাদের সেফ ভাই । আমরা সবাই ফুড মিনিস্টার হিসেবে ডাকি। আমাদের সবার প্রিয় মানুষ। চ্যানেল এস এ বেড়াতে গেছেন অথবা কোন কাজে গেছেন। আর আপনি না খেয়ে আসবেন সেটা হবে না। খুবই অতিথি পরায়ণ আমাদের নাজিম ভাই।
যে কথা বলছিলাম পান। পান তো লন্ডনে নাই। কিন্তু জলিল ভাই বলেছেন। পান লাগবে এখন আমার সর্বোচ্চ চেস্টা তো করতে হবে। পাপলু ভাই সহ অনেক ব্যাবসায়ী ফোন দিলাম কিন্তু পানের কোন খবর নেই। আমার বাসার পাশের দুটি দোকানেও গেলাম কিন্তু পান নেই।অনেক চেস্টার পর , অনেক খোজাখুজির পর খবর পেলাম রহিমস এর হ্যাকনী ব্রান্জে পান আছে। চলে গেলাম রহিমস এ লাইনে দাঁড়ায়ে কাউন্টারে গিয়ে বললাম পান। আছে প্রথমে না বললেও পরে যখন চ্যানেল এস এর কথা বললাম তখন সেল্স ম্যান ড্রয়ারের ভিতর থেকে এক প্যাকেট পান। কাগজে প্যাকেট করা পলিথিনে দিলেন। মূল্য মাত্র £৫ । ক্যাস দিতেই সেইলসম্যান আসতে করে বলে দিলেন।” কাউকে বলবেন না পানের কথা।হ্যাঁ বলে গাড়ীতে করে অফিসে যাওয়ার পথে আহাদ ভাইকে নিয়ে গেলাম। আমি অফিসে না যেয়ে আহাদ ভাইকে পান দিয়ে বললাম জলিল ভাইর পান তবে নাজিম ভাইকে দিলেই হবে। সেই দিনের সেই পান স্বর্নের চেয়েও দামী, হিরার চেয়েও মূল্যবান।
জলিল ভাইর হাত পর্যন্ত যেতে যেতে সেই মহামূল্যবান পানের পরিমান কমে গেছে। বাংলাদেশের ত্রান বিতরনের মত। সরকার থেকে গরীবের হাতে পৌঁছতে পৌঁছতে কিছুই থাকেনা। অনুরুপ ভাবে , আহাদ ভাই, নাজিম ভাই ডিসটিবিউট করেছেন কিছু , চোখের সামনে পান দেখে যে জীবনেও কোন দিন খায়নাই তারও যেন পান খাওয়ার ইচ্ছা জেগেছে। জীবনে আর কিছু খাই আর না খাই পান খাবো। জলিল ভাই পান হাতে পেয়ে অনেক দু:খ পেয়েছেন। সাথে সাথে আমাকে ফোন করলেন। বললেন পানের করুন অবস্থা কথা। আমার কিছুই যেন বলার নেই। সামান্য পানের জন্য দু:খ পেলে কি আর করা। আমার কাছে পান সামান্য জিনিস হলেও , পান পিয়সিদের জন্য মহামূল্যবান।
আসলে পানের এক অদ্ভুত নেশা। যারা নিয়মিত পান খান কিন্তু হঠাৎ করে পান না পাওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আশা হতাশার ছায়া। খাবারের পর এক খিঁলি পান না হলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা হয় না।
করেনাভাইরাসের কারনে সকল দেশের সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারনে পানের এই মহা সংকট।
পান নিয়ে লন্ডনে এই করোনায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা। হায়রে পান, তুমি আমার জানের জান।
তোমারে ছাড়া বাছে না পরান।
ওরে ও পানওয়ালা,
তুই আমারে করলি দেওয়ানা।
যদি সুন্দর একটি মুখ পাইতাম।
সদর ঘাটের পানের খিঁলি ,
আমি তারে খাওয়াইতাম।
করোনাভাইরস একটি মহামারির নাম। এই মহামারিতে সেই গানের মত সুন্দর মুখ এবং মুখ গুলিকে ম্লান করে দিয়েছে।
আছে চূন, সুপারী এবং সেই সুন্দর মুখ কিন্ত নেই শুধু পান।
তাই ইচ্ছা থাকা সত্যেও পান খাওয়াতে পারছে না।
আর এই মহামারি আমাদের কে করেছে বিছিন্ন। বিশ্ব থেকে বিছিন্নকরে করেছে ঘর বন্ধি। বদলে দিয়েছে দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
করোনার কারণে লক ডাউন আর লক ডাউনের কারণে ফ্লাইট বন্ধ।এমতাবস্থায় বাংগালী কমিউনিটিতে হাহাকার পড়েছে পানের জন্য অনেক ঘরে মা,চাচি,খালাদের অবস্থা ভয়াবহ। মামা,চাচাদের অবস্থাও বেগতিক কারণ এদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে পান সুপারী। অনেক দোকান ঘুরে ঘুরেও যখন পান ,না পাওয়া তখন কি আর করা। হতাশা নিয়ে ঘরে ফিরা ।মনকে তো আর মানানো যায় না তাই অনেক জায়গায় থেকে খবর পায়া যায় পানের বদলে যে কোন সবুজ পাতা, আলু শাক, কদুর শাক, লেবুর পাতা খেয়ে পরিক্ষা করা হচ্ছে যাতে কিছুটা স্বাদ পাওয়া যায় কি না? অথবা তেজপাতার কিম্বা দাঁড়চিনি অথবা লং চিপিয়ে ও মিটছেনা পানের সাধ।
যুক্তরাজ্যে করোনার সংক্রমন ভয়াবহ।এরই মধ্যে জরুরী কাজে বাংগালী দোকানে গেলে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবে ভাই পান আছে কিনা?
করোনার কবল থেকে মুক্ত হয়ে পান ও সব্জি সরবরাহের ব্যবস্থা না হলে , ব্রিটেনের বেশীর ভাগ ঘরেই অশান্তির সৃস্টি হবে। এমনকি ডমেস্টিক ভাইওলেন্সে পরিনত হতে পারে। কেননা পান ও বাংলাদেশী সব্জি খেয়ে খেয়ে এমন অভ্যাসে পরিনত হয়ে এখন অভ্যাস থেকে বদঅভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
সেদিন আমার স্ত্রীর তার দুই বান্ধবীর সাথে আলাপ করছেন এক জন মাহিরার আম্মা, অন্যজন ইরানার আম্মা দুজনেই পানের ভক্ত ছিলেন । শুধু ভক্ত বললে ভুল হবে। পান ছাডা তাদের জীবন বৃথা। সেই মাহিরার মা বলছেন, “ জানেন ভাবী আমি পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি”। অথচ পান ছাড়া তার জীবন যে চলে না সেটা সবার জানা । মনকে তো বুঝাতে হবে তাই গর্ব করে বলে আমি পান খাইনা।পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এটা কিন্তু বলার বিষয় তবু পান না পেয়ে মনের দু:ক্ষুটা হাল্কা করলো ।
সেই গল্পের মত “আংগুর ফল টক। “
পাই না তাই খাই না। এমন অনেকেই আছেন ইচ্চে থাকা সত্যে ও না পাওয়ার কারনে এখন পান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।
আমার অফিস চ্যানেল এস।অফিসের বস থেকে শুরু করে প্রায় সবাই পানের ভক্ত। করোনাভাইরসের আগেও চ্যানেল এস এর ,ফুড মিনিস্টার আমাদের সবার প্রিয় নাজিম উদ্দিন ভাই নিয়মিত পান খেতেন । খাবারের পর এক খিলি পান না হলে যেন শান্তির ঢেঁকুর আসে না।অফিসে যাওয়ার আগে সপ্তাহে এক থেকে দুই বার পান নিয়ে যেতে হতো। পানই যেন নাজিম ভাইর প্রাণ। সেই প্রাণ এখন বেশ কয়েক দিন ধরে যায় যায় অবস্থা।
বেশ কিছু দিন ধরে সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ থাকায় কোন ধরনের কাঁচামাল , সব্জি, পান সহ অন্যান্য মালামাল যুক্তরাজ্যে আসছে না। পান সংকট শুধু লন্ডন নয় এ সংকট সমগ্র যুক্তরাজ্য জুরে। এমন কি সারা বিশ্বজুরে।
গত কাল খাবারের টেবিলে চ্যানেল এস এর ,এম ডি তাজ চৌধুরী বললেন। “ কাল সকালে কাঁচা বাজারে পান আসবে।” আমি মনে করলাম এ খবরটা বুঝি এক মাত্র আমিই জানলাম। কিন্তু না সকাল এগারোটায় চ্যানেল এস এর প্রোগ্রাম প্রডিউসার আহাদ আহমেদ ভাই কে অফিসে ড্রপ দিয়ে ছুটলাম পানের সন্ধানে। ভাবলাম পান যখন কিন্তে যাবো তখন আমার স্ত্রী কেও নিয়ে যাই । পান ও কেনা হবে আবার বাসার বাজার করাও হবে।ফোন দিয়ে রেডী হতে বললাম। অফিস থেকে বাসা হয়ে এবার ছুটে চললাম ভ্যাক্টনের মাছ বাজার কাঁচা বাজারের অভিমুখে । পান কিনতে। ভ্যাক্টনের বেশ বড় এলাকা নিয়ে বেশ কিছু মার্কেট। চতুর্দিক দিয় মার্কেট আর মাঝ খানে কয়েক শত গাড়ীর কার পার্ক। এই মার্কেট এলাকায় প্রবেশ করতেই হাতের ডানে আইসল্যান্ড শপ এর পরই মাছ বাজার কাঁচা বাজারের বিশাল শপ এটাই মনে হয় লন্ডনে বাংলাদেশী মালিকানাধীন সব চেয়ে বড় সুপার মার্কেট ।অবশ্য এদের আরো অনেক গুলি শাখা আছে।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম, কার পার্কিং করতে যেয়ে দেখি অবাগ কান্ড।গাড়ী আর গাড়ী।
“যেন তিল ঠাঁই আর নাহিরে,
ও গো যাসনে ঘরের বাহিরে”
সেই কবিতার কথা মনে পড়ে গেল । গাড়ী পার্ক করে
নেমে দেখি বিশাল, বিশাল এবং বিশাল বড় লাইন। ভেবে ছিলাম পানের কথা বুঝি আমি একাই জানি।
আসলে তা নয় এ খবরটি বাতাসে বাতাসে সবাই পেয়েছে। একটি পানের জন্য সেই যে লাইন মাছ বাজারের গেইট থেকে শুরু করে একই লাইনের সব গুলি শপ পার হয়ে অপর পাশের মাতালানা সপ পর্যন্ত কয়েক শত বললে ভুল হবে কয়েক হাজার লোক।
একবার ভাবছিলাম ফিরে যাবো কিন্তু আমার প্রিয়তমা বললেন “ বেশী সময় লাগবে না, তুমি ট্রলি নিয়ে আসো , আমি লাইনে দাঁড়াই”।যে কথা সেই কাজ। সে লাইনে গেলো আমি ট্রলি আনতে গেলাম। যেতে যেতে সেই শেষ মাথায়। দীর্ঘ সময় লাইনের পর যখন একেবারে গেইটের সামনে তখন অবস্থা বেগতিক দেখে কাগজে লিখে বাইরে লাগিয়ে দিল নো পান। সাথে সাথে লাইন থেকে মানুষ গুলি উধাও হয়ে গেল। সেই দৃশ্য নিজের চোখ কে বিশ্বাস করানো কঠিন। নিমিষেই হাজার থেকে শত লোকে পরিনত হলো ।
শপিং শেষ করে বাসায় এসে একটু দেড়ীতে জুহুর নামাজ আদায় করে , দুপুরের খাবার শেষ করতেই নাজিম ভাইর ফোন বললেন “হুয়াইট চ্যাপেল ইউকে ফিস বাজারে পান আছে।” আবার ছুটে চললাম ইউকে ফিস বাজারে । শপের সামনে বড় করে লেখা পান নাই। হাঁট বাজারে যেতেই , হাট বাজারের কর্মকর্তা আক্তার ভাই বললেন, “আমাদের পান নাই এখানে নাই, আপনি শ্যাডোয়েল কাঁচা বাজারে যান। সেখানে পাবেন”।ছুটে গেলাম সেখানে । সেখানেও শেষ , হতাশ হয়ে বাসায় যাচ্ছি, এমন সময় চ্যানেল এস এর চিফ রিপোর্টার মোহাম্মদ জুবায়ের ভাইর ফোন করে বললেন” হুয়াইট চ্যাপল আহম্মেদ ভেজিটেবল এ পান আছে।আপনি গিয়ে নিয়ে আসেন”। শেষ পর্যন্ত সেখান হুয়াইট চ্যাপেল আহমেদ ভেজিটেবল থেকে পান নিয়ে অফিসে এলাম । পান নিয়ে এসেছি এটাই এখন বড় তৃপ্তি। এসে সরাসরি নাজিম ভাইকে পান দিলাম। নাজিম ভাইর সেই প্রাণ খোলা হাঁসি। সাথে ছবি তুলতে ও ব্যাস্ত। তিনি চান এই আনন্দ মূহুর্তটুকু স্মৃতির পাতায় ধরে রাখতে। ছবিটি তুলে দিলেন ভিডিও এডিটর পাপ্পু দাস,পানের খবর পেয়ে চ্যানেল এস এর ফাউন্ডার মাহি ফেরদৌস জলিল তার অফিস থেকে নিচে এলেন।পান দেখে তিনিও আনন্দের হাসি হাসলেন।
একটি পান যে মানুষকে এতো আনন্দ দিতে পারে তা করোনাভাইরস নামক মহামারি এসো বুঝিয়ে দিলো।
এভাবেই কতশত মানুষের মনে শান্তি, মুখে হাঁসি আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে দেয় এক খিলি পান।