রেক্সিট চুক্তি বাস্তবায়নে,
ইউরোপের ২৭ দেশের এ্যাম্বাসেটরদের জরুরী মিটিং।
মো: রেজাউল করিম মৃধা।
২৪শে ডিসেম্বর ২০২০ ইউকের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও
ইইউ-এর প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন সাথে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ইইউ তাদের একটি ‘ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ’ ব্রেক্সিট চুক্তি হয়েছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ও কোন কোন বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, কে কতটা ছাড় দিয়েছে তা নিশ্চিত করার জন্য খসড়া চুক্তি গুলিকে বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপের ২৭ দেশের এ্যাম্বাসেটরদের ব্রাসেলসে জরুরী মিটিং চলছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধান বাণিজ্যিক সমঝোতাকারী লর্ড ফ্রস্ট জানিয়েছেন, চুক্তির ১ হাজার ৫০০ পৃষ্ঠার নথি শিগগিরই প্রকাশ করা হবে। এখানে সব গুলি ইসু পরিস্কার ও স্বচ্ছ ভাবে তুলে ধরা হবে এবং সেজন্য আমাদের টীম কাজ করে যাচ্ছেন।
যে সব চুক্তি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
১/শুল্কমুক্ত বাণিজ্য
যুক্তরাজ্য এবং ইইউ’র মধ্যে বাণিজ্যে নতুন করে কোনও শুল্ক বা কোটা আরোপ হচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত করেছে দুই পক্ষই। তারপরও ব্রিটিশ রপ্তানিকারকরা বেশ কিছু নতুন নীতির সম্মুখীন হবেন, যার ফলে ইউরোপে ব্যবসা করা তাদের জন্য আগের চেয়ে কিছুটা কঠিনই হবে।
২/পণ্যের উৎস নীতি
নতুন নিয়ম অনুসারে, ইইউ’তে রপ্তানির আগে যুক্তরাজ্যকে তাদের পণ্যের উৎস নিশ্চিত করতে হবে। কোনও পণ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ যদি ইইউ বা যুক্তরাজ্যের বাইরে থেকে আনা হয়, তাহলে সেই পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক বসানো হতে পারে।
৩/ পরীক্ষা ও ছাড়পত্র
দুইপক্ষের মধ্যে সাধারণ স্বীকৃতির চুক্তি না থাকায় ব্রিটিশ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ এখন আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে পণ্য বিক্রির ছাড়পত্র দিতে পারবে না। এটা তাদের বাণিজ্যের জন্য একটি বড় বাধা হতে চলেছে।
৪/ আর্থিক সেবা
ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয় এখনও পরিষ্কার নয়। এতে তথাকথিত সমতা প্রতিষ্ঠার কোনও সিদ্ধান্ত নেই। চুক্তিতে শুধু আর্থিক পরিষেবার মানদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যার অর্থ- সেখানে বাজারে প্রবেশাধিকার সম্পর্কিত কোনও প্রতিশ্রুতি নেই।
৫/ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড
চুক্তিতে উভয় পক্ষই তাদের পরিবেশগত প্রতিশ্রুতি, সামাজিক, শ্রম ও শুল্কের বিষয়ে স্বচ্ছতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছে। যুক্তরাজ্য বলেছে, চুক্তিতে এমন কোনও গোপনীয় বিষয় নেই যার কারণে ভবিষ্যতে নিয়মকানুন কঠোর করতে হতে পারে।
৬/ প্রয়োজনীয় ভর্তুকী
তবে দুই পক্ষই নিয়মের খুব বেশি পরিবর্তন করলে সালিশের ভিত্তিতে একে অপরের ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারবে। তাছাড়া, কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে ব্রিটিশ সরকারের ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে অসন্তুষ্টি থাকলে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাজ্যের আদালতে নালিশ জানাতে পারবে।
যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, দুই পক্ষকেই ভর্তুকির ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকতে হবে। সরকারি ভতুর্কি তদারকিতে তাদের মধ্যে একটি স্বাধীন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন।
৭/ ভবিষ্যৎ বিরোধ নিষ্পত্তি
চুক্তির অধীনে ন্যায়সঙ্গত হলে যেকোনও পক্ষই অন্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে পারবে। যদি কোনও পক্ষ মনে করে, এধরনের শুল্ক আরোপ করে তাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, তবে ইস্যুটি তারা সালিশ প্যানেলে উপস্থাপন করতে পারবে। তবে সেই সালিশ প্যানেল হতে হবে পুরোপুরি স্বাধীন এবং সেটি ইউরোপীয় বিচারিক আদালত হতে পারবে না।
চুক্তির কোনও বিশেষ অংশে ঝামেলা দেখা দিলে সেটি পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আর চুক্তিতে কাজ না হলে সেটি পুরোপুরি বাতিলেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
৮/ মৎস্যশিকার নীতি
এটি ইইউ-যুক্তরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোর একটি। চুক্তি অনুসারে, যুক্তরাজ্যের নৌযানগুলো আগামী পাঁচ বছর ব্রিটিশ জলসীমায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিকার করা মাছের ২৫ শতাংশ নেবে। এর মূল্য হতে পারে ১৪৬ মিলিয়ন পাউন্ড। আলোচনার শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের দাবি ছিল ৮০ শতাংশ নেওয়ার। অর্থাৎ, চুক্তির জন্য তারা এই ক্ষেত্রটিতে বড় ছাড় দিয়েছে।
৯/ বিমান ও ট্রাক চলাচল
ব্রিটিশদের উড়োযান সম্পর্কিত নকশা ও পণ্যের স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন একপ্রকারে বন্ধ করে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। চুক্তির নথি অনুসারে, যুক্তরাজ্যের ছাড়পত্র ব্যবস্থাপনার ওপর ইইউ’র আত্মবিশ্বাস ফিরে না আস পর্যন্ত এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই।
তবে, ট্রাক বা লরি চলাচলের ক্ষেত্রে দুই পক্ষই কার্যকর ভিসা ও সীমান্ত ব্যবস্থা অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
১০/ তথ্যপ্রবাহ
ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তিতে তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে একটি সাময়িক সমাধানের কথা বলা হয়েছে। ইইউ যতদিন পর্যন্ত তথ্য পর্যাপ্ততার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে, ততদিন দুই পক্ষের মধ্যে তথ্যপ্রবাহ অবিচ্ছিন্ন থাকবে।
তবে এই ব্যবস্থার মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ছয়মাস। ইইউ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তথ্যপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে, যা ২০২১ সালের শুরুতেও হতে পারে।
১১/ জ্বালানি পন্য
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি বাজারে আর প্রবেশাধিকার থাকছে না যুক্তরাজ্যের। এটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে যুক্তরাজ্য ও ইইউ’র মধ্যে থাকা বিশাল বৈদ্যুতিক লাইনের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতে ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে নতুন ব্যবস্থা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য বিদ্যুৎ আমদানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তাদের ৮ শতাংশ বিদ্যুতই আসে অন্য দেশ থেকে। সেক্ষেত্রে সংযোগকারী বৈদ্যুতিক লাইনের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্রিটিশদের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তিতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখারও গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, দুই পক্ষের কেউ যদি ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ভঙ্গ করে, তাহলে বাণিজ্য চুক্তিটি বাতিল হতে পারে।
১২/পেশাগত সেবা
ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশদের জন্য পেশাগত দক্ষতার স্বয়ংক্রিয় স্বীকৃতির সুবিধাটি আর রাখছে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফলে যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক, নার্স, ডেন্টিস্ট, ফার্মাসিস্ট, পশু চিকিৎসক, প্রকৌশলী বা স্থপতিরা ইইউভুক্ত যে দেশেই কাজ করতে চান, সেখানকার স্বীকৃতি দরকার হবে।
তবে দক্ষতার স্বীকৃতির জন্য চুক্তিতে একটি ফ্রেমওয়ার্কের কথা বলা হয়েছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্য।
১৩/ ব্যবসায়িক ভ্রমণ
ব্যবসায়িক ভ্রমণের ক্ষেত্রে ইইউ-জাপানের মধ্যে যেধরনের চুক্তি রয়েছে, যুক্তরাজ্যও অনেকটা সেধরনের সুবিধা পাবে। সেই অনুসারে, যেকোনও ১৮০ দিনের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীরা ইউরোপীয় দেশগুলোতে ৯০ দিন অবস্থান করতে পারবেন।
১৪/ আইন প্রয়োগ
সন্ত্রাস বা যেকোনও গুরুতর অপরাধ তদন্তে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইইউ-যুক্তরাজ্য। এক্ষেত্রে ডিএনএ, আঙুলের ছাপ বা বিমানযাত্রীদের তথ্য আদান-প্রদান করা হতে পারে।
১৫/ ভ্রমন এবং যাতায়াত ,
নতুন চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ নাগরিকদের ইউরোপ ভ্রমনে ভিসার প্রয়োজন হবে না। তবে আপনি কতদিন ইউরোপের দেশগুলো থাকবেন তার উপর নির্ভর করবে।
১৮০ দিনের মধ্যে ৯০ দিনের বেশি ইউরোপের দেশগুলোতে থাকা যাবেনা। যদি আর দীর্ঘদিন থাকার প্রয়োজন হয়, সেখানে লেখা পড়া বা কাজের প্রয়োজন হয় তবে আপনাকে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
কোন কোন ক্ষেত্রে আপনার রির্টান টিকিট রয়েছে, ভ্রমনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে তা প্রমানের প্রয়োজন হতে পারে।
১৬/ বিদেশী স্বাস্থ্যসেবাঃ
ইউরোপীয় স্বাস্থ্য বীমা কার্ড (EHIC) – যা আপনাকে অস্থায়ী থাকার সময় রাষ্ট্রীয় সরবরাহিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অধিকার দেয় – এটি আর বৈধ হবে না। পরিবর্তে, সরকার বিদেশে যাওয়ার আগে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবার সাথে উপযুক্ত ভ্রমণ বীমা পাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
১৭/ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণঃ
আপনাকে সীমানা নিয়ন্ত্রণ পোস্টে আপনার রিটার্নের টিকিটটি দেখাতে এবং আপনার থাকার জন্য পর্যাপ্ত টাকা রয়েছে তা প্রমাণ করতে হতে পারে। পর্যটকরা শেঞ্জেন অঞ্চলের দেশগুলিতে ভিসা ছাড়াই যাতায়াত করতে সক্ষম হবেন
এছাড়া ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ইউরোপে ২৭ দেশের এ্যান্বাসেটর সহ উর্ধতন কর্মকর্তারা বড় দিনের উৎসব রেখে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে জরুরীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।