| | |

ভুল ট্রেনে, ভুল যাত্রা।


মো: রেজাউল করিম মৃধা।

মাসের নাম সরাসরি মনে নেই তবে রবিবার রাত এটা মনে আছে কারন সকাল এম্বাসী যাবেন মাসুদ ভাই। আরো মনে আছে ১৯৯৬ সাল। কেননা ঐ বছর আমি রোম ছেড়ে কয়েক মাস ভিসেন্সায় কাজ করে ছিলাম।ঐ সময়টা মানুষের একটি হিড়িক ছিলো চল চল ভিসেন্সা চল।নতুন কাজের সন্ধ্যান মানে ভিসেন্সা।

আমি এবং মাসুদ ভাই ভিসেন্সা থেকে ইতালীর রাজধানী রোমে যাবো। ভিসেন্সা থেকে সরাসরি রোমে যাওয়ার কোন ট্রেন নেই। লোকাল ট্রেনে পাদোভা যেতে হয় এবং পাদভা থেকে বিভিন্ন শহরে যাওয়া যায়। অনেক ছোট ছোট শহর আছে যেখানে রাত দিন মিলে মাত্র দুইএকটি ট্রেন যাতায়াত করে। ভিসেন্সা চামড়া শিল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও যোগাযোগ ব্যাবস্থা ততটা উন্নত নয়। দিনে রাতে মিলে মাত্র কয়েকটি ট্রেন যাতায়াত করে। সেই ট্রেনের অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা অথবা অনেকেই টাইম টেবিল না জানা থাকায় স্টেশনে এসেও পরবর্তী ট্রেনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়।

আমরা আগের দিন এসে টাইম টেবিল যেনো গেলাম। ভিসেন্সা থেকে পাদভা এর পর ট্রেন চেন্স করে সোজা রোম টের্মিনি। সবই ঠিক ছিলো

কিন্তু যদি থাকে নসীবে আপনা আপনি আসিবে।

আমরা দুজনে ভিসেন্সা থেকে এসে সোজা চলে গেলাম নির্দিষ্ট প্লাটফর্মে যেতেই দেখি ট্রেন দাঁড়ানো এক দৌড়ে আমরা দুজনে উঠে গেলাম। কোন লেখা না দেখে সময় না দেখে। সাথে সাথে ট্রেনের গেইট বন্ধ হয়ে গেল আমরা দুজনে সিটে বসে খোস গল্প শুরু করলাম। দুই জন মহা আনন্দে।

তখন রাত প্রায় বারোটা না বাঁজলেও আমাদের বারোটা বেঁজে তেরোটা হয়ে গেছে।

কেননা আমরা ভুল ট্রেনের ভুল যাত্রী চলছি উল্লটো পথে। অনিশ্চিত উদ্দেশে। মাসুদ ভাই আবার হার্ডের রোগী। দেখতে শুনতে সুঠাম দেহের অধিকারী হলেও ভিতরে ভিতরে সব শেষ। ট্রেন যাচ্ছে উল্টে পথে।

বুঝতে পেরে নেমে যাওয়ার চেস্টা করেও কোন লাভ নেই। ট্রেন চলছে তো চলছেই। হুসাইল বাঁজিয়ে দাপটের সাথে দুই ধারের গাছপালা শহর পেরিয়ে চলছে তো চলছে।

আমাদের দুজনের মনের ভিতর খটখট আওয়াজের ধ্বনী সবকিছুকেই ছাপিয়ে যাচ্ছে।

কি হবে ?

কি করবো?

কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

মাসুদ ভাই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছেন। এতো অল্পতে তিনি এতো ঘাবরিয়ে যাবেন সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

আমি সান্তনা দিতে চাই।

তিনি রেগে যান।

বললাম ভাই একটা কিছু হবে।

তিনি বলেন -ঘোড়ার ডিম হবে। সকালে আমার অনেক কাজ এ্যাম্বাসীতে যেতে হবে আরো কত কি? তার মাথায় এ্যাম্বাসীর ভুত চেপেছে। ছুটির মধ্যেই তার কাজ শেষ করতে হবে। আবার কাজে যোগ দিতে হবে। সেই চিন্তায় তিনি মশগুল।

সব দোষ মনে হচ্ছে আমার। উদুর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেস্টা আর কি?

মনে মনে হাঁসি

নাহ আমার কোন দোষ নেই ।

আর যদি দোষ হয় সে দোষ দুজনের সমান।

ভুল হতেই পারে তা মেনে নিতে হবে। না মাসুদ ভাই মানতে রাজি নন।

কিছুক্ষন পর টিটি এলেন,

টিটি দেখে মাসুদ ভাই তো মূর্সে যাওয়া অবস্থা। তিনি মনে করেন হয় জরিমানা করবে না হয় অন্য টিকিটের জন্য বেশী টাকা দিতে হবে।

আমি বললাম আপনি বসেন,

আমি কথা বলছি!

যথাযথ সম্মান দিয়ে ইতালীয়ান ভাষায় বললাম। আমরা আসলে রোমের যাত্রী!

ভুল করে পাদভা থেকে মিলানের ট্রেনে উঠেছি।

এখন আপনার হেল্প চাই।

আমার অতি বিনয়ী এবং ভদ্র ব্যাবহারে মনে হলো টিটির মন গলে গেছে।

টিটি হেঁসে ফেললেন।

এমন ঘটনা নতুন নয়। টিটি বললেন অনেক সময় হয়।ভুল করে আমরা আগের ট্রেনে উঠেছি। সেই একই প্লাট ফর্মে পরের ট্রেনটি ছিলো রোমের উভয় ট্রেন সমুদ্রের রানী খ্যাত ভেনিস থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন। যার গন্তব্য এক এক দিকে তবে পাদভা হচ্ছে ইতালীর বড় একটি ট্রেন স্টেশন। মিলানো , রোম, নাপলী, সহ বড় বড় স্টেশনে ট্রেন গুলি থেমে থাকলেও পাদভা শুধু মাত্র যাত্রী নেওয়ার জন্য যতটুকু সময় এই সময়ের যে যার গন্তব্যের ট্রেনে উঠতে হবে। আর ভুল হলে দিতে হবে আমাদের মতো খেসারত।

টিটি অন্য যাত্রীদের টিকিট চেক করে পরে আবার আমাদের কাছে আসলেন।

বললেন,” তোমরা এক কাজ কর সোজা মিলানো চলে যাও। মিলান থেকে ভোর ৫ টায় একটি ট্রেন আছে তোমরা সেই ট্রেনে করে রোমে যাবে।

টিটি আমাদের টিকিট নিয়ে

সাথে আরো দুইটি টিকিট এ্যাড করে দিলেন।

বললেন,” তোমাদের আর পে করতে হবে না। আমি টিকিট দিয়ে দিচ্ছি,”। যাতে অন্য টিটি এসে তোমাদের ঝামেলায় না ফেলে এবং মিলানো থেকে রোমে যেতে এক্সটা অর্থ না দিতে হয়।

আসলে সব খানেই ভালো মানুষ আছেন। আমরাও কৃতজ্ঞতা ভরে টিটিকে সম্মান জানালাম।

এবার দেখলাম প্রিয় মাসুদ ভাইর চোখে মুখে এক আশার আলো।

আমার প্রতি তার বিরক্তি কিছুটা হলেও মিটে গেছে।কিন্তু সেই কালো রাত কখনো ভুলার নয়। সেই রাতটি হয়তো অনেক দীর্ঘ ছিলো ! ছিলো এক মহা হতাশার।

আমরা মিলানো স্টেশনে পৌঁছলাম তখন গভীর রাত। কত বাঁজে মনে নেই।

মিলানো ট্রেন স্টেশন অনেক পুরাতন। ঐতিয্যবাহী একটি ট্রেন স্টেশন। এর পূর্বে মাত্র একবার এসে ছিলাম এই স্টেশনে। তখন ট্রেন এসে থেমেছে। আমরা নেমেছি আর আমার খালাতো ভাই মোজাম্মেল হোসেন আকাশ আমাদের রিছিপ্ট করে নিয়ে গেছেন। সেই যাত্রা ছিলে এক আনন্দের কিন্তু আজকের এই যাত্রা মহা হতাশার।

ট্রেন এসে থামলো সব যাত্রী নেমে যাচ্ছে আমাদের ও নেমে যেতে হবে। না হলে এই ট্রেন হয়তো আবার ছুটে যাবে অন্য এক দিকে। সবার সাথে সাথে আমরা নেমে পরলাম । আপনারা জানেন মিলানো ট্রেন স্টেশন বেশ উঁচু স্থানে। সেই খান থেকে সিডি বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে হয়। নিচে নামলে সুন্দর পরি পাটি এবং পাশের ইন্সরেন্চ কম্পানির সুউচ্চ কাঁচের বিল্ডিং এই বিল্ডিং মিলানো শহরের আইকন নামে পরিচিত।

ট্রেন স্টেশনের সামনে বাস স্টপ এবং ট্রেন স্টেশনের নিচ দিয়েই মেট্রো লাইন। এতো ভোরে সেই মেট্রো লাইন খুলে নাই। তাই বাস এবং মেট্রো লাইনে কোন লোকজন নেই। সামনে গিয়ে আবার ফিরে এলাম যাতে অন্য কোন বিপদ না হয়। বিপদের হাত পা নেই। আর যখন বিপদ আসে চতুর্দিক দিয়েই আসে। শুনেছি মিলানোতে মরক্কীদের বেশ দাপট।

আমরা দুই জন নেমে কিছুক্ষন বাইরে ঘরে আবার ট্রেন স্টেশনের মধ্যে প্রবেশ করলাম। দুই একটি ছবি তুলতে চেয়ে ছিলাম কিন্তু ক্যামেরা না থাকায় সেই ছবি তোলা সম্ভব হয় নাই। তবে আজো সেই স্মৃতি মনের মাঝে এবং চোখের সামনে ভেঁসে উঠে বারবার।

ভোর পাঁচটার অপেক্ষা এবার সঠিক ট্রেন ধরতে হবে না হলে আবার কোন বিপদ হবে কে জানে?

খুব খেয়াল করে ট্রেনে উঠতে হবে । এখানে প্রায় ১৪টিক মতো প্লাটফর্ম । ট্রেন আসছে যাচ্ছে বিভিন্ন দিকে।

সেই কবির ভাষায় বলতে হয়।

“নোঙর আমার ঘাটে ঘাটে।

মনের নোঙর পইরা রয়েছে সারেং বাড়ির ঘাটে”।

সারাটা রাত আমরা দুজনে একটু ঘুমাতে পারি নাই। টেনশন, দূশ্চিন্তা, ভয় এবং কি হয়? কি হয়?

ভোর পাঁচটার কয়েক মিনিট পূর্বেই রোমে যাওয়ার ট্রেনের প্লাটফর্ম এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। ট্রেনে উঠার আগে টিটি সহ অন্য যাত্রীদের কেও জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে ট্রেনে উঠলাম। কথায় আছে চুন খেয়া মুখ পুরলে দই দেখলেও ভয় হয়। একবার ভুল করেছি সেই ভুল যেন বারবার না হয়।

এতোক্ষনে হয়তো আমরা রোমে থাকতাম এখন আরো ৩/৪ ঘন্টা সময় লাগবে। ট্রেনে উঠে সিট নিয়েই বসতে না বসতেই মাসুদ ভাই ঘুমিয়ে গেলেন। নাগ ডেকে ঘুম। আমার আবার নাগ ডাকার পাশে ঘুমানো কস্ট কিন্তু ঘুম মানে না জাতি কূল। মাসুদ ভাইর না ডাকা ঘুম শুনতে শুনতে আমি যে কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেও জানিনা।

জানালা দিয়ে রোদের প্রবেশের কারনে রোমে আসার কিছুক্ষন আগে আমাদের ঘুম ভেংগেছে না হলে হয়তো আবার নেপলী যেতে হতো।মাসুদ ভাইকে ডাকলাম।

উঠেন আমরা রোমের কাছে এসেছি।

উরামুডি দিয়ে ও এসেছি?

উঠলেন

উপর থেকে ব্যাগ নামালেন।

ব্যাগ নেরেচেরে দেখলেন।

হু ?

ট্রেন এসে থামলো পৌনে আটটায়।

আমি বলাম মাসুদ ভাই খুব ভালো সময় এসেছি। আপনি সরাসরি এযাম্বাসীতে যেতে পারেন।

মাসুদ ভাই বললেন দেখি কি করা যায়?

নেমে গেলাম দুজন

এরপর আর কখনো মাসুদ ভাইর সাথে দেখা হয় নাই।

কিন্তু ভুল ট্রেনের স্মৃতি আজো মনে পরে।

সেই ভুল ট্রেন নিয়েই আমাদের যাত্রা।

কখন কোথায় পৌঁছবো আমরা কেউ জানি না।


Similar Posts