বৃটেনের রানীকে কাছ থেকে দেখা।

মোঃ রেজাউল করিম মৃধা।
সেই ৯/১০ বছর আগের কথা।
২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক হিসাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটি সংবাদ কাভার করার সুযোগ হয়েছিলো। রাজকীয় সংবাদ কাভারের সেই অভিজ্ঞতা, রানিকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা জীবনের স্মৃতি হয়ে আছে এবং থাকবে চিরকাল।
২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রানি আসবেন ইস্ট লন্ডনের দি রয়েল লন্ডন হাসপাতাল পরিদর্শন ও উদ্বোধন করতে।দি রয়েল লন্ডন হাসপাতালের নতুন ভবন নির্মাণের পর রানী উদ্ধোধনী অনুস্ঠান।
আমি তখন বাংলা টিভিতে নিউজে কাজ করি। ইব্রাহিম খলিল ভাই এবং আমার দুইজনের দ্বায়িত পরলো এই নিউজ কভারের। আপনারা জানেন ভিআইপি ইভেন্টে কভারের ৭ থেকে ১০ দিন আগেই কাউন্সিল থেকে পার্মিশন নিতে হয়। বাংলা টিভির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ সামাদুল হক তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন।”আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার দি রয়েল লন্ডন হাসপাতাল উদ্বোধন করতে আসবেন বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাভেদ। সকাল ১০.০০টার মধ্যেই আপাকে এবং ইব্রাহিম খলিলকে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।আমি কাউন্সিলে রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানের নাম দিয়ে দিয়েছি”।
ড্রেসকোড থেকে শুরু করে কি করা যাবে , কি করা যাবে না সবই নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। আমি জী হ্যা ঠিক আছে বলে রুম থেকে চলে এলাম।
তখন থেকেই আমার মনের মধ্যে এক অন্য ধরনের অনুভূতি শুরু হয়েছে। বৃটেনের রানীর সাথে দেখা হবে। তাকে কাছ থেকে দেখবো কিম্বা সুযোগ পেলে হাত মেলাবো। সেই অনুভুতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
যাইহোক মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে বৃটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতা নেত্রী, ব্যাবসায়ী নেতৃবর্গ ,এমপি ,মেয়র স্পীকার , কাউন্সিলার,বাংলদেশের এবং বৃটেনের রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা সহ বৃটেনের সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সহ অনেক মন্ন্ত্রী এমপি কিম্বা বিরোধী দল লেবার নেতা স্যার কেয়ার স্টারমার, সাবেক লিডার জেরেমী করবিনের সাথে দেখা হয়েছে। সাথে ছবি তোলার ও সুযোগ হয়েছে।কিন্তু রানীর সাথে দেখা হওয়ার অনুভূতি অন্য রকম।
নির্ধারিত দিন সকাল ১০.৪৫ মিনিটে পৌছে গেলাম হাসপাতালে। সেই খানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো প্রেসের জন্য নির্ধারিত জায়গায়। রয়েল লন্ডন হাসপাতালের পেছনের যে প্রবেশ পথ, যেটাকে স্টেপনী ওয়ে বলা হয়।
রানি আসবেন তাই এই স্টেপনী ওয়ে রাস্তার দু পাশে বেরিয়ার দিয়ে রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র কিছু মানুষ, হাসপাতালের স্টাফ আছেন।এই রাস্তায় ব্যস্ততা নেই। ঠিক ১১টায় প্রবেশ করলো রানিকে বহন করা গাড়ি, কালো রংয়ের রেন্জ রোভার। সামনে দুটি মোটর সাইকেলে নিরাপত্তা। রানীর গাড়ি এসে থামলো। রানী এসে নামলেন আমাদের ঠিক সামনে ১ হাত দূরে। সেখানে শুধু আমরা নির্ধারিত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলাম।
প্রথমে রানির স্বামী ডিউক অব এডিনবরাহ প্রিন্স ফিলিপ, পরে নামলেন রানী। পরনে ছিলো লাইনার কালারের স্কার্ট পরা রানিকে অসাধারন লাগছিলো। সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়।রানী নেমে মানুষের দিতে তাকালেন , হাত নাড়লেন। তারপর রানি আমাদের দিকে তাকালেন, হাসলেন, হেটে ভেতরে ঢুকে গেলেন। রানিকে অভ্যর্থনা জানান টাওয়ার হ্যামলেটসের তখনকার স্পিকার রাজীব আহমদসহ এনেইচএসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। উপস্থিত মানুষের করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠলো।সেদিন হাসপাতালের অনেকটাই রানি ঘুরে দেখেন। কিছুটা সময় কাটান বাচ্চাদের ওয়ার্ডে।
তারপর তিনি দেখতে যান ২০০৫ সালে অল্ডগেইট স্টেশনে বোমা হামলায় আহত একজনকে। তাকে রানি ২০০৫ সালে একই হাসাপাতালে দেখছিলেন। তাদের মধ্যে মিনিট খানেক কথোপকোথন হয়। রানিকে সেই রোগী জিজ্ঞেস করেন, আমাকে চিনতে পেরেছেন? রানি হেসে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন আপনি।
প্রায় ১ ঘন্টা ছিলেন সেদিন। এনএইচএস ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার স্টিভেন ও’ব্রেইন বলেছিলেন, ঠান্ডার দিনে সবচেয়ে উষ্ণতম ঘটনা। রানির সাথে দেখা হওয়ার সেই অভিজ্ঞতা অম্লান হয়ে থাকবে স্মৃতির পটে।
বৃটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাভেদ কতটা জনপ্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুর পর দেখা গেছে। মানুষের ভালোবাসা।
গত ৮ই সেপ্টম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ বিদায়ের পর উনসর ক্যাসেলে তাকে সমাহিত করা হয় ১৯শে সেপ্টেম্বর।
১৪ই সেপ্টেম্বর তার কফিন বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনিস্টারের সিটি হলে দেওয়ার ব্যাবস্থা থেকে দেখা যায়।জীবিত রানীর চেয়ে মৃত্যু রানীই যেন বেশী জনপ্রিয়।
ওয়েস্টমিনিস্টার থেকে হাইড পার্ক সহ সমগ্র সেন্টার লন্ডন লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতি।সেন্টার লন্ডনে গাড়ি নিয়ে চলাচলে বর্তমানে চলছে বিধিনিষেধ। আন্ডার গ্রাউন্ড ই একমাত্র ভরসা। কিন্তু হাজার হাজার যাত্রী ধারন করা বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
চ্যানেল এস নিউজ কভারেজ করতে কারেন্ট এফিয়ার্স এডিটর তানভির আহমেদ ভাই সহ মাইল এ্যান্ড থেকে আন্ডার করে ওয়েস্টামিনিস্টারে নেমে দেখি ওয়েস্টমিনিস্টার এবির রাস্তা বন্ধ। বিশাল ওয়াল দেওয়া হয়েছে। এখানের কিছু ফুটেজ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিটি হলের দিকে রওয়ানা হলাম। সিটি হলের সামনে ও হাজার হাজার মানুষ সেখানে রাস্তা বেরিকেড দেওয়া কিন্তু লোকের যেন কমতি নেই।
এরপর এমবার্কমেন্ট থেকে আন্ডার গ্রাউন্ডেড ডিস্ট্রিক লাইনে আবার ওয়েস্টমিনিস্টার হয়ে জুবলি লাইনে গ্রীন পার্কে নামলাম কিন্তু সেখানেও পুরো গ্রীন পার্ক বড় ওয়াল দিয়ে আটকানো পুলিশ এবং সিকিউরিটি সবাইকে হেঁটে হেঁটে হাইড পার্কে যেতে বলছেন। হাইড পার্কে বড় পর্দায় রানী কফিন নেওয়ার দৃশ্য সরাসরি সমপ্রচার করা হবে।
আপনারা জানেন হাইড ব্রিটেনের একটি বৃহৎ এবং ঐতিহাসিক পার্ক। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখানে একসাথে সমবেত হতে পারে। রানীর কফিন দেখার জন্য লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় রানী কতটা জনপ্রিয়।
রানীর শেষ বিদায় ১৯শে সেপ্টেম্বর। ওয়েস্টমিনিস্টার এ্যাবিতে সেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের রাস্ট্র প্রধানরা সহ ৫০০ শত ভিআইপি অতিথি মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও উপস্থিত ছিলেন।
৮ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১০ দিনের রাস্ট্রয়ী শোক ছিলো। সকল অফিস আদালতে পতাকা ছিলো অর্ধ নির্মিত।তার ৯৬ বছর বয়সে ৭০ বছরের ও অধিক সময় নিতি দেশের রানী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন।
রানীর ছিলেন মানবতার রানী। এজন্য তার মৃত্যুর খবরের পর থেকে বৃটেন সহ সারা বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া। স্কটল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ড সব স্থানেই রানী প্রতি ভালোবাসার নির্দর্শ হিসেবে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। রানীর কফিন বা তার মুখ দেখতে না পারলেও তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার কমতি নেই। নিরাপত্তার কারনে বাকিংহাম প্যালেসে প্রবেশ করতে না পারলেও গ্রীন পার্কে ফুল দিয়ে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করে হাজার হাজার মানুষ।
রানীকে শেষ বিদায় জানাতে তার কফিন কে এক নজর দেখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাস্ট্র প্রধানর সহ সাধারন মানুষের উপস্থিতি বলে দেয় রানী ছিলেন মানবতার রানী।মানুষের ভালোবাসার রানী।
রানীকে কাছ থেকে দেখা এবং রানীর সমাধী বা শেষকৃত অনুস্ঠানের আনুষ্ঠানিকতার সাথে সম্পৃক্ত থেকে নিউজ করতে পারায় নিজে ধন্য মনে করছি।