ফেলে আসা ইতালী,স্মৃতির পাতায়, রংগীন দিন। (পর্ব-১০)

কাজ আমাকে পেতেই হবে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে এক রেস্টুরেন্টে গেলাম। কাস্টমারের ভীর ভিতরে বুঝা যাচ্ছে। যারা কাজ করছেন। তারা হাঁপিয়ে উঠছেন। রেস্টুরেন্টটির নাম “লা তাভারনেতা” স্টেশনের উল্টো পাশে । রিছিপশনে যে , আমি বললাম “সেরকো লাভোরো”। রিছিপশনিস্ট বললেন,”আসপেত্তারে”।আমি অপেক্ষা করলাম, একটু পরেই চলে এলেন, কাপু দি পারতে – বনোছেরা বলে ছালাম দিলাম। নাম মারিও। কাজ খুজতেছি বলাতেই অভিজ্ঞতা আছে কিনা? জানতে চাইলেন। আমি বললাম নাই তবে যে কোন কাজ দিলে আমি করতে পারবো। কথা বলার বেশী সময় নেই তার হাতে শুধু বললেন, ছেলাই দকুমেন্তো ? আমি বললাম সি, লেন্জার কপি দেখালাম। সাথে সাথে বললেন, “ভিয়েনে কন মি”।আমি তার পিছনে পিছনে গেলাম। সোজা কিচেনে। লাভা পিয়াত্তি কাজে। কিচেনের সবাইকে এক নজরে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শুরু হলো কাজ। জীবনের প্রথম কাজ। মনে আছে সে দিন রোজা ছিলাম। সন্ধ্যা কই রাত কই কিছুই মনে নেই। শুধু কাজ আর কাজ। অবশ্য এখানেও ভাগ্য ভালো আর একজন বাংলাদেশী এখানে কাজ করতেন। তার নামও রেজা। পুরাতন বাংলাদেশী সবাই তাকে রেজা পাগলা বলে ডাকে কেননা রেজা ভাই একটু বেশী কথা বলেন। দুজনের নাম মিল রেজা এবং রেজাউল হওয়াতে মারিও আমার দিলেন কারিম, আমার পুরা নাম মো: রেজাউল করিম মৃধা। সহজ নাম কারিম সেই থেকে যত দিন ইতালী ছিলাম সবাই কারিম বলেই ডাকতো।
রেজা ভাই আইউতো কুক অর্থাৎ সেফের এ্যাসিসট্ন্ট । দাপট আছে আমি নতুন কতক্ষন পর পর মারিও এসে দেখে যায় আমি প্লেট ধূইতেছি তো ধূইতেছি। মাঝে মধ্যে কাটলারিজ এসে হাজির সাথে গ্লাস। দম ফালানের সময় নেই। এতো কাস্টমার আগে কখনো হয় নাই। সেফ বললেন, “তু ছেই ফরতুনাতো”। ফরতুনাতো হলেই আমার কি? রোজা ছিলাম রেজা ভাই শুধু এক গ্লাস পানি দিয়ে ছিলেন সাথে কি ছিলো মনে নেই তবে রেজা ভাইর ও কিছুই করার ছিলো না। কাটলারিজ ধোওয়ার জন্য মেশিন ছিলো কিন্তু মেশিনে দিতে হবে এবং বের করে মুছে দিতে হবে। আমার কাছে সে সময় টুকুও নাই।
মাঝে মধ্যে রেজা ভাই এসে দেখিয়ে দেন কিভাবে পরিস্কার করতে হয়। কিন্তু কাটলারিজ পরিস্কার করা তাদের মত হয় না। টাওয়ালের মধ্যে মুট করে ধরে , টাওয়ালের আর এক মাথা দিয়ে ঝাটঝাট করে সামনে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু আমার টা হয়না আমি একটা একটা করে পরিস্কার করি এতে অনেক সময় লেগে যায় তখন রেজা ভাই এসে সাহায্য করতে চান কিন্তু সেফকেও সাহায্য করতে হয়। প্লেট এসে ভরে যায় পুরো লাভাদ্রিস। প্লেট ধূওয়া শুরু করি। এভাবে কখন রাত ১১ টা বেঁজে গেছে টের পাইনি শেষ প্লেট গুলি চলে এলো প্লেট ধূয়া শেষ করে ফ্লোর পরিস্কার করতে করতে রাত প্রায় ১২ টা এবার বিদায়ের পালা। মারিও সেফ এর নিকট কাজ সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলেন সেফ এক কথায় বললেন,ব্রাভো। মারিও বললেন, ছিভিদিয়ামো দোমানি আলে দুয়ে।সেই থেকে শুরু হলো দিনের দুটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ।
অবশ্য কাজ শেষ করতে প্রায় ১২টা বেঁজে যেতো। কাজ শেষে করে বাসায় হেঁটে যেতে সময় লাগে ১২ থেক ১৫ মিনিট। প্রথম রাতে কাজ শেষ করে বাসায় যাচ্ছি মনে হচ্ছে রাস্তা বহু দূর এ পথ যেন শেষ হবার নয়। পা যেন আর চলছে না। দীর্ঘ দিন পর এত পরিশ্রম।দীর্ঘ দিন বললে ভুল হবে। জীবনের প্রথম এত পরিশ্রম। দীর্ঘ সময় ধরে একটানা কাজ কখনোই করি নাই। পা যেন আর চলে না। যাইহোক হেঁটে হেঁটে বাসায় গেলাম। প্যান্টের মধ্যে কিছু কিছু ময়লার দাগ লেগে আছে সে দিকে অবশ্য ভ্রুক্ষেপ নেই। বাসায় ডুকতেই দেখি প্রায় সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। শুধু মোল্লা ভাই আমার জন্য জেগে আছেন। এর আগে কখনোই এত রাতে বাসার বাইরে থাকিনি। তাই মোল্লা ভাই অপেক্ষায় আছেন,আমাকে মোল্লা ভাই অনেক আদর করেন তাই আমারে নিয়ে চিন্তায় ও আছেন। কোথায় গেলাম? কি করলাম? দু:শ্চিন্তা মোল্লা ভাইর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । এবং একটি খুসির খবর ও তার কাছে রয়েছে। বাসায় ফোন এসেছিল একটি কাজে যাওয়ার জন্য। তখন তো আমার মোবাইল ফোন ছিলো না। আমার কেন? শতকরা ৯৯ পারসেন্টের হাতে মোবাইল ফোন ছিলোনা। তখন মোবাইলের যুগ ছিলো না। তখন এক মাত্র ছিল ল্যান্ড ফোন।
মোল্লা ভাইকে বললাম “ভাই আমি কাজ পেয়েছি এবং আজ কাজ করে এসেছি”। আমার কাজের কথা শুনে মোল্লা ভাই অনেক অনেক খুঁসি হয়েছিলেন। মোল্লা ভাই বললেন তোমার জন্য আর একটি কাজের ফোন এসেছিলো। কথায় আছে যখন হয় চতুর দিক দিয়েই হয়। বললাম অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিন। বাসায় তখন অনেক বেকার লোক ছিলো। মোল্লা ভাই একজন কে পাঠিয়ে ছিলেন সেই কাজে।সেই থেকে শুরু হলো আমার কাজ।শুরু হলো চাকরী জীবন। পরে অবশ্য সুবিধা মত কাজ পরিবর্তন করেছি কিন্তু প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা কখনো ভুলতে পারি না।শাখাওয়াত মোল্লা ভাই আমাকে চাকুরীজীবি বা চাকুরে বলে ডাকা শুরু করলেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কাজ চলেছে।সময়ের সাথে পালা বদল হলেও কাজ থেমে নেই।ভিন্ন সময় ভিন্ন কাজ। ভিন্নশহরে ,ভিন্ন দেশে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা।এখনো কাজ করে যাচ্ছি ভিন্ন অভিজ্ঞতায়।