ফেলে আসা ইতালী,স্মৃতির পাতায় রংগীন দিন। (পর্ব-৩)

Italy

তিন চার দিন পর দুটি চিঠির সন্ধান করলেন আলহাস খন্দকার ভাই। কত দিয়ে কিনেছেন জানিনা । যে লোকের চিঠি তার নাম সেলিম শাহ । এখন নাম পরিবর্তন হয়ে যাবে সব কিছুই সেলিম শাহর নামে করতে হবে। এরকম অনেকেই নাম পরিবর্তন করেছেন। আমার জানা মতে অনেক হবে। দুই একটি উদাহরণ দিচ্ছি আমার একেবারে পরিচিত বন্ধু বা বড় ভাইদের মধ্যে। ইয়াকুব আলী ভাই উনি কাগজ করলেন নাসির উদ্দিন নামে সেই থেকে উনার নাম নাসির উদ্দিন।মনির হোসেন আমার খুব কাছের বন্ধু দীর্ঘ দিন রুমমেড হিসেবে ছিলাম এখন পারিবারিক সম্পর্ক হয়ে গেছে। নতুন নাম আফজাল হোসেন।আলহাস ভাই উনি হয়ে গেলেন সেলিম শাহ তবে তিনি অনেক কস্ট করে খন্দকার যোগ করেছিলেন। অবশ্য আলহাস ভাই মজার মানুষ । মজা করে বলতেন “সেলিম নামটি আমার খুব প্রিয় ছিল বাবা মা রাখেনি। এখন থেকে আমিই রাখলাম,”।এরুপ অনেক মানুষ পাবেন যারা এই কাগজের জন্য বাবা মায়ের দেওয়া নাম পরিবর্তন করছেন। তবে নাম পরিবর্তনের সাথে আকিকা করছেন কিনা আমার জানা নাই।

আলহাস ভাই বললেন, তুমি চিন্তা করোনা আমার কাছে দুটি চিঠি আছে আমি কালই কস্তুরায় যাবো একটি চিঠি দিয়ে দিবো যদি হয়ে যায় তবে অন্যটি তোমার। মেঝ ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে আমাকে আদর করে তুমি বলে। ডাকেন ।ঠি ক যে কথা সেই কাজ । আলহাস ভাইর কাগজ জমা নিয়েছে। কাগজ জমা দিয়ে সোজা আমাদের বাসায়। অর্থাৎ মোতালেব মোল্লার বাসায় হাজির তখনো সকাল কেননা সকালেই কাগজ জমা নেয়। ভোর রাতে গিয়ে কস্তুরার সামনে লাইনে দাঁড়াতে হয় ১০০ জন কে ডেকে নিয়ে কাগজ জমা রাখে অথবা ডকুমেন্ট পুলিশের পছন্দ না হলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বের করে দেয়।এজন্য সবাই ভয়ে থাকেন কারটা জমা নিবে কারটা জমা নিবে না কেউ বলতে পারে না । জমা হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই দু:স্চিন্তায় থাকেন। আলহাস ভাই কাগজ জমা দিয়ে রিছিপট এনেছেন। এ রিছিপটকে লেন্জা বলতেন সবাই। লেন্জা পাওয়া মানেই কাগজ পাওয়া । লেন্জা হাতে আলহাস ভাই আজ অনেক খুঁশি।

কলিং বেল এর শব্দে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলতেই এক রাশ হাঁসি নিয়ে আলহাস ভাই উপস্থিত বললেন, “আজ আমি অনেক খুঁশি তোমাকে মিস্টি খাওয়াতাম কিন্তু কোন মিস্টির দোকান নেই। তাই তোমাকে পিচ্চা খাওয়াবো। মোল্লা ভাই কথার শব্দে ঘুম থেকে উঠে বসলেন। আলহাস ভাইর সাথে গল্প শুরু করলেন।আমার হাতে একটি চিঠির খাম বা ইনভেল্ভ দিয়ে বললেন। যাও এবার তোমার কাগজও হয়ে যাবে।

তখনও পাসপোর্ট বানানো হয়নাই কেননা কোন নামে বানাবো সেটা ঠি ক না হলে বারবার পাসপোর্ট বানানো অনেক ঝামেলা । তাই আগে কাগজ জমা দিয়ে সেই নামে পাসপোর্ট বানাচ্ছেন সবাই।শুধু চিঠিই নয় ভিয়া কাভুরে ইউল অফিস। ঐ অফিসে চিটাগাং এর রফিক ভাই কাজ করেন তিনিও বাংলাদেশীদের অনেক সাহায্য করেন। চিঠি নিয়ে সাথে এক কপি ফোটো নিয়ে গেলাম। মেম্বার ফি মাত্র £১০ মিলে লিরা। ফি জমা দিয়ে একটি সদস্য কার্ড করলাম। যদি এই কার্ড ব্যাক ডেট হতো তাহলেতো সোনায় সোহাগা কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। পুলিশের সন্দেহ হলে সবাইকে জেলের ভাত খেতে হতে পারে।যাইহোক এবার দুটি ডকুমেন্ট কস্তুরায় যাওয়ার মানুষিক প্রস্তুতি আরো বেড়ে গেল। দিনটি আমার কাছে বেশ উৎফুল্ল মনে হতে লাগলো।

কিরনও একটি ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেছে।ভোর রাতে যেয়ে লাইন দিতে হবে। জানুয়ারী মাস বুঝতেই পারছেন প্রচন্ড শীত। আজ বেশী কথা নয় তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পরলাম কিন্তু চোখে ঘুম নেই কতক্ষনে লাইনে যাবো সেই চিন্তা। আর দেড়ী সহ্য হচ্ছে না। মধ্যরাতেই আমি আর কিরন দুজনে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি কিছুটা ভয় তো আছেই নতুন শহর নতুন জায়গা অবশ্য এ কয়েক দিনে আমরা বন্ধুরা মিলে বেশ কিছু জায়গা ঘুরেছি। ভেটিক্যান সিটি, পিয়াচ্ছা ভেনেছিয়া, কলোসেও, পিয়াচ্ছা রিপাবলিকা , বাংলাদেশ এম্বাসী, কস্তুরা সহ বিশেষ প্রয়োজনীয় স্থান গুলি। বাস নাম্বার গুলি মুখস্ত করেছি কোন বাস কোথায় যায়। তবে ভিয়া ন্যাশনাল ধরে সামনে কিছু দূর হাঁটলেই ভিয়া জেনেভায় রোমের কস্তুরা বা থানা।

রাত বারোটার পর বাস নেই শুধু ২/১টি নাইট বাস তাও আবার বিশেষ রোডে অনেক পর পর চলে। পিয়াচ্ছা ভিক্টরিয়া আর স্টেশনে টেরমিনির মাঝামাঝি রোড়েই মোল্লা ভাইর বাসা । বাসা থেকে আমরা দুজন বের হলাম সামনে যেতেই অনেক গুলি হোটেল এই হোটেল গুলির বেশীর ভাগ কাস্টমারই এখন বাংলাদেশী। হোটেল গুলির বেশ রমরমা ব্যাবসা কোন হোটেলেই সিট খালি নাই। কোন কোন হোটেলে আবার পিছিপশনে বসেও অনেকে রাত পার করেছেন। হোটেল ক্যানেডি নামের একটি হোটেলে বাংলাদেশী রাকিব ভাই কাজ করতেন বাংলাদেশী হলে হোটেলে সিট না থাকলেও রিছিপশনে বসে থাকার অনুমতি দিতেন। সেই সময় সবাই নতুন দের সহযোগিতা করেছেন। এখন সম্ভব কি না জানিনা? হোটেল এডিয়ায় আসতেই আরো দু এক জন পেলাম গল্প করতে করতে স্টেশনে টেরমিনির বাম পাশের রাস্তা দিয়ে পিয়াচ্ছা রিপাবলিক হয়ে যাচ্ছি তখন আরো দু জনের সাথে দেখা রাস্তায় বের হলেই দু একজন বাংলাদেশী পাবেনই কেননা কারো চোখে ঘুম নেই যতক্ষন না কাগজ জমা দিতে পেরেছে। অবশ্য মেঝ ভাই এরই মধ্যে কাগজ জমা দিয়ে প্যারিসে চলে গেছেন। আজ চলে গেলেন আলহাস ভাই। এমনি যে যত তাড়াতাড়ি কাগজ জমা দিতে পারেন তত তাড়াতাড়ি তিনি কার গন্তব্যে ফিরে যেতে পারেন।

পিয়াচ্ছা রিপাবলিকা হয়ে ভিয়া ন্যাশনাল হয়ে হেঁটে কয়েকটি রোড পরেই ভিয়া জেনেভা এখানেই সবার ভাগ্য নির্ধারনের স্থান। কস্তুরার সামনে যেতেই আমাদের আগেও দেখি অনেক লোক এসে লাইনে আছেন। শুধু বাংলাদেশী না বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনেক লোক । গেইট খুলবে সকাল ৭ টায় কিন্তু তখন রাত আর করতো হবে আড়াই কিম্বা তিনটা এরই মধ্যে এতো লোক যাইহোক আমরা মুটামুটি ২০/২৫ জনের মধ্যেই আছি । ১০০ জনের মতো জমা নিবে। তাই আমরা নিশ্চিন্ত আমরা জমা দিতে পারবো।তখন শুরু হলো গুরিগুরি বৃস্টি, হাল্কা বাতাস, বুঝতেই পারছেন অবস্থা কি তবে ভাগ্য ভালো আমাদের দুজনের একটি ছাতা । দুজনের মাথা রক্ষা হলেও শরীর ভীজে যাচ্ছে অবশ্য সেদিকে আমাদের কারো খেয়াল নেই। আমার ভারী জ্যাকেটমাথায় টুপি, হাতে গ্লাবস তার পরও জুতার ভিতর থেকে ঠান্ডা যেন আক্রে ধরার চেস্টা করছে। রাত গভীর থেকে ভোর হতে শুরু করলো কখন গুরিগুরি বৃস্টি চলে গেছে বলতে পারবোনা তবে কিছু ক্ষনের মধ্যে একদল মরোক্কি এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলো। হাতের ছাতা কোথায় উধাও গেছে। কিন্তু মরোক্কিরা বেশী সুবিধা করতে পারে নাই।

আমরা বাংলাদেশীরা সংখ্যায় অনেক বেশী । নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থাকলেও অধিকার আদায়ে আমরা ঐক্যবন্ধ । সেই রাতে সেটাই প্রমানিত হলো। মরোক্কিদের সামনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই।

ভোর হতে লাগলো আমাদের সবার চেহারায় ও আলোক ঝলকানিতে ভোরে উঠতে লাগলো। সকাল ৭.০০ বাজতেই ডাক পরে গেল। সামনে থেকে এক এক জন করে ভিতরে যেতে লাগলো। কেউ বের হচ্ছে লেন্জা হাতে আনন্দের হাঁসি নিয়ে আবার কেউ বের হচ্ছে কালো মুখ করে। মুখ দেখলেই বুঝা যায় কে জমা দিতে পেরেছে কে পারে নাই। আমাদের ডাক এলো ভিতরে গেলাম। পুলিশকে সাহস করে বুনজুর্ন বলে ইতালীয়ান ভাষায় সালাম দিলাম।পুলিশ ও মুছকি হেঁসে বুনজুর্ন উত্তর দিলো। পুলিশ বললেন, “দাই ডকুমেন্ত” আমি চিঠি জমা দিলাম দিলাম সাথে ইউল অফিসের কার্ড। পুশিল চিঠি টাকে কয়েক বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে দেখলেন। আমাকেও দেখলেন । এর পর বললেন, “দবে আবিতি” আমি বললাম” কাম্পো,”আমি সঠিক উত্তর দিতে পারি নাই কারন আমাকে বলা হয়েছিল এই চিঠির মালিক রোমের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশে থাকেন। তাই কাম্প বললেই বুঝবে। কিন্তু পুলিশ বুঝে ফেলেছে আমি সেই ব্যাক্তি নই। পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়া সত্যি কঠিন ।অথবা গত কাল এই পুলিশের কাছেই আলহাস ভাই এই নাম কাগজ জমা দিয়েছেন।সন্দেহ হলে পুলিশ ডরুমেন্ট ছিঁড়ে ফেলে দেয় কিন্তু আমার টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন। বাই ভিয়া ।তখন খুব কস্ট পেয়ে ছিলাম। ভীষণ কস্ট। মুখ ভার করে বাইরে এলাম । পা আর চলতে চায় না সারা রাত জাগার ক্লান্তি ভর করে বসলো। বসবো কি হাঁটবো কিছুই বুঝতে পারছিনা । অপেক্ষা করছি এরই মধ্যে কাগজ জমা দিয়ে বীরের বেশে বের হয়ে এলো কিরন বিয়াই। আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ।ওর আনন্দ আর আমার নিরানন্দ। ভরাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় চলে এলাম। আমার মন খারাপ দেখে সবাই আমাকে সান্তনা দিতে লাগলো। মোতালেব মোল্লা ভাই বললেন, তোমার সব ঠি ক আছে তুমি আবার ট্রাই করো। দবে আবিতি সহ আরো কিছু ভাষা শিখতে লাগলাম। পরের দিন কিম্বা পরের সপ্তাহে সঠিক মনে নেই আবার গেলাম কিন্তু ভাগ্য খারাপ আগের মত কাগজ জমা না নিয়ে এবার চিঠিটি ছিডে ফেলে দিলো। মন খারাপ করে বাসায় এলাম।


Similar Posts