ফেলে আসা ইতালী,স্মৃতির পাতায়, রংগীন দিন। (পর্ব -৬)
যে কথা বলছিলাম। আমার ভাগ্য অনেকটা সুপ্রসন্ন । আল্লাহ সব সময় আমাকে বেশী মায়া করেন। বড়রা আদর করেন। যেখানে কেউ বাসা পায়না সেখানে আমার কোন সমস্যা হলো না । নিজের নামে কাগজ। সব একের পর এক হতে লাগলো।কিন্তু আমাদের যেনো দেড়ী সহ্য হয় না। এখনই চাই। তাড়াতাড়ি চাই।আল্লাহ পরীক্ষা করেন । আমরা ধর্য্য ধারন করতে পারি না। আল্লাহ ধর্য ধারন কারীদের বেশী পছন্দ করেন।
আমি আসার আগেই মেঝ ভাই আব্দুল মোতালেব মোল্লার বাসায় আমার থাকার ব্যাবস্থা করে রেখেছেন। মেঝ ভাই সপ্তাহ খানেক হোটেলে থেকেই কাগজ জমা দিয়ে আবার প্যারিসে চলে গেলেন। মেঝ ভাই যে দিন রাতে প্যারিস চলে গেলেন। সেদিন আমার খুব খারাপ লেগেছিলো।মেঝ ভাই দীর্ঘ দিন ধরেই প্যারিসে আছেন। যেহেতু এসাইলামে ছিলেন। দেশে যাওয়া আসার জন্যই তার এই ইতালীর কাগজ করা। তবে তিনি বেশী দিন এই কাগজ হোল্ড করেননি।শুধু দুই এক বার দেশে গিয়েছিলেন ইতালী হয়ে ।এক দেশে থেকে অন্য দেশের কাগজ রক্ষা করা মুশকিল। সেটা শুধু মাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন।
কাগজ জমা দিয়ে যে দিন রাতে চলে যাচ্ছিলেন রোমের বৃহৎ ট্রেন স্টেশন রোমা থেকে। বাসা থেকে হেঁটে হোটেলের সামনে এলাম। মেঝ ভাই হোটেল থেকে বের হয়ে এলেন। দুই ভাই হেঁটে হেঁটে স্টেশনে এসে টিকি ট কেটে ট্রেনের দিকে যাচ্ছি আমার তখন আমার কাছে বেশ অসহায় মনে হচ্ছিল। তখন মনে হচ্ছিল আজ আমি সত্যিই একা। আপন ভাইকে বিদায় দেওয়া খুবই কস্টকর। হোক দেশে কিম্বা বিদেশে।নতুন শহর সবাই নতুন। নেই কাগজ। নেই কাজ। অবশ্য তখন কাজের তেমন চিন্তা ছিলো না। চিন্তা একটাই সেটা হলো কাগজ। ঘড়ির কাটায় বলছে ট্রেন ছাড়া সময় হয়েছে।মেঝ ভাইকে বিদায় দিয়ে ভরাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় এলাম।
আব্দুল মোতালেব মোল্লা ভাই বাসাও নতুন নিয়েছেন। কারেন্ট নাই। কয়েক দিন পর অবশ্য কারেন্ট চলে আসে কারন বাসার নতুন মালিকের নামে কারেন্ট আনতে হয়। প্রথম দিনে মোল্লা ভাই আমাকে এবং কিরন বিয়াইকে হোটেলের রিছিপশন থেকে সাথে করে নিয়ে এলেন। হেঁটে আসার সময় বাসার নিয়ম কানুন সম্পর্কে বলতে লাগলেন। আমি আর কিরন বিয়াই শুনতে লাগলাম। মনে হতে লাগলো এ কোন দেশে এলাম ?এ যেন এক জেলখানা।
জোরে কথা বলা যাবেনা। শব্দ করে হাঁটা যাবেনা। বেশী রাতে বাইরে থাকা যাবে না। এক সাথে সবাই ঘরে ঢুকতে পারবেন না। বাই রোটেশন রান্না করতে হবে সাথে ঘর পরিস্কার। ইত্যাদি ইত্যাদি। মাথা নেরে , হু হু করে জবাব দিচ্ছি । বাসায় প্রবেশ পথ ।বিশাল গেইট ইতালীর বাসা গুলির মেইন গেইট গুলি এমনিই অনেক সুন্দর। মোল্লা ভাই চাবি দিয়ে খুব আস্তে করে মেইন গেইট খুললেন যাতে শব্দ না হয়। কেউ যেন বুঝতে না পারে এ বাসায় এত লোক আসা যাওয়া করে।এর পর সিঁডি দিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠতে লাগলাম । পা ফেলতে লাগলাম টিপে টিপে যাতে আওয়াজ না হয়। বাসার দরজা প্রবেশ করলাম । অন্ধকার। আমি অার কিরন বিয়াই একটু দাঁড়ালাম। মোল্লা ভাই একটি মোমবাতি ধরিয়ে নিয়ে এলেন। বিশাল বড় বিল্ডিং এর এক তলায় বাসা ।
ঘরে ডুকেই দেখি আরো দুই/ তিন জন বাসায় আছেন। মোমবাতির আলোতে সালাম বিনিময় হলো। দুটি রুম একটি বড় একটি বেশ ছোট। বড় রুমে চার কর্নারে সিংগ্যাল কয়েকটি খাট। এক পাশে একটি অালমারি। ছোট রুমে একটি বক্স খাট। বক্স খাটের সাথেই উপরে ছোট ছোট তিনটি বক্স এবং এক পাশে আলমারি বক্স খাটের নিচে আর একটি খাট দিনে ভিতরে ডুকিয়ে রাখা হয় শুধু ঘুমানোর সময় বের করে ঘুমাতে হয়। অপর পাশে আর একটি সিংগ্যাল খাট।বক্স খাটে থাকেন মোল্লা ভাই। তিনি আদর করে আমাকে বললেন। তুমি আমার পাশেই থাকবে। বক্সের ভিতরের ছিট আমার হয়ে গেল।
পাশের রুমে কিরন বিয়াইকে দেওয়া হলো । এই বাসায় আগে থেকে যারা ছিলেন শাখাওয়াত ভাই। আপনারা অনেকেই চিনেন, দীর্ঘ দিন মোল্লা ভাইর দোকানে কাজ করেছেন। খুবই অমায়িক লোক ছিলেন।হাসি মুখে কথা বলতেন।দু:ক্ষ জনক ভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রোমের পলেক্লিনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন। (ইন্নাহ নিল্লাহ——- —- রাজিউন )। মোল্লা ভাই যে সব নিয়ম বললেন। সপ্তাহ খানেক ও সে নিয়ম টি কাতে পারেননি। হতে লাগলো তার উল্টো। যেখানে দুই রুমে থাকার কথা ৬ জনের সেখানে এমন কোন রাত গেছে ১৫,২০ এমন কি ২৫/২৬ জন পর্যন্ত মানুষ ঘুমিয়েছে। ফ্রান্স থেকে কেউ অাসলে তার প্রথম ঠি কানাই মোল্লা ভাইর বাসা। এছাড়া এলাকার লোকতো আছেনই । কে রান্না করে কে খায়, কোন হিসেব নেই। এ যেন এক সমগ্র খানা।মোল্লা ভাই দয়ালু মানুষ কাউকে না করতে পারেন না। যে বলে আপনার বাসায় থাকবে। মোল্লা ভাই ওকে। দিনের চেয়ে রাতে বেশী হয়ে উঠতো মানুষের সমাগম। মোল্লা ভাই অবস্থা বেগতিক দেখে ফিউরি কামিল্লি মেট্রো স্টেশনের পাশে আরো একটি বাসা নিলেন। সেখানেও এক অবস্থা। কে রান্না করে কে খায়, কার সিটে কে ঘুমায়। এটা মেইনটেইন করা মোল্লাভাইর পক্ষে সম্ভব ছিলো না কেউ হয়তো ভাড়া দিতেন কেউ দিতেন না।
আর খাবারের কথা ভাত থাকলেও তরকারি পাওয়াটা ছিলো ভাগ্যের ব্যাপার। যারা রান্না শেষ হওয়ার সাথে সাথে খেতেন । তারা ছিলেন বুদ্ধিমান কিন্তু যারা দূরে কাজ করতেন কিম্বা বিভিন্ন সময় ব্যাস্ত থাকতেন। তারা এসে কখনো তরকারি পেতেন কখনে পেতেন না। প্রটেস্ট করেও লাভ নেই। নতুন নতুন মানুষ। কে কার খবর রাখে। স্টেশন এবং পিয়াচ্ছা ভিক্টোরিয়ার কাছে বাসা। সবার জন্য অতি সহজ মোল্লা ভাই সামাজিক ও দয়ালু মানুষ। তাই যার যখন খুসি বাসায় আসতো এবং খেয়ে দেয়ে হয় চলে যেতো না হলে যে বেড খালি পেতো সেই বেডে একটা লম্বা ঘুম দিতেন।