ফেলে আসা ইতালী,স্মৃতির পাতায় রংগীন দিন।(পর্ব-৭)

তখন নতুন নতুন লোকে লোকারন্য। প্রতিদিনই শত শত লোকে আসেন এই রোম শহরে। থাকার জায়গা নেই। শুধু যে বাংলাদেশী তা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক এখানে আসতে শুরু করে। থাকার কোন জায়গা নেই। বাংলাদেশের মধ্যে আন্তরিকতা আছে তারা নতুন দের স্বাগত জানায়। নিজেদের কস্ট হলেও অন্যদের থাকতে দেয় কিন্তু অন্যদেশের লোকদের কি সেই ব্যাবস্থা আছে? মনে হয় নেই। বিভিন্ন সাহায্য কারি সংস্থা, গীর্জায় কিম্বা পার্কে এবং স্টেশনের আশেপাশে তারা দখল করে নেয় যেখানেই একটু সুযোগ সেখানেই রাতে ঘুমিয়ে পরে। সে এক অমানবিক দৃশ্য। স্বচোক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
একদিন হঠাৎ খবর পেলাম। দিন তারিখ মনে নেই তবে প্রচন্ড শীত এটা পরিস্কার মনে আছে। রোমা স্টেশন থেকে ভিয়া কাসেলিনা যেতে পর্তামেজরের পর পানতানেল্লার পরিত্যাক্ত ২/৩ টি বিশাল বিল্ডিং মরোক্কীনী, আফ্রিকান এবং পাকিস্তানিরা দখল করেছে। মূহুর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পরলো । তখন যদিও মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না তারপরও মানুষের মুখে মুখে হাওয়ায় হাওয়ায় খবর ছড়িয়ে গেল। বাংলাদেশীরা ও এসে যোগ দিলো। কথায় “আছে মাইরের আগে, দরবারের শেষে” বাংলাদেশীরাও এখানে এসে অবস্থ করেন।কিন্তু ইতালীতে বাংলাদেশীদের তখন কার অবস্থান ছিল অনেক শান্ত।
পাশাপাশি বড় বড় বিল্ডিং পরিত্যাক্ত কেউ থাকে না ভাজ্ঞা চূড়া। ভাজ্ঞা হলেই কি হবে। তবুতো মাথা গুজার ঠাঁই হলো। মূহুর্তের মধ্যে হাজার হাজার লোক কাঁথা বালিশ নিয়ে হাজির। হাজার হাজার লোক সামাল দিতে পুলিশ এসে হাজির হলেও কোন লাভ হচ্ছেনা। জোড় করে , পিটিয়ে , মেরে তো কাউকে বের করতে পারবে না। যে শুনে পান্থান্ল্লায় বিনা পয়সায় থাকা যায় সেই বাসা ছেড়ে চলে আসে এই বিল্ডিং এ । এ বিল্ডিং এ থাকা নিয়ে , মরেক্কো, আফ্রিকান, বা পাকিস্থানীদের সাথে মাঝে মধ্যেই চিল্লাচিল্ল , ধাক্কা ধাক্কি, মারামারি হতো। এখানে আবার বাংলাদেশী সবাই এক।একটি সিট বা এক একটি রুম বাংলাদেশীরাও থাকতে শুরু করলেন।
রচন্ড শীত, বেশীর ভাগ জানালার কাঁচ ছিলো ভাজ্ঞা, টয়লেট ছিলো নস্ট। রান্নার জন্য গ্যাস নেই । রান্নার জায়গা নেই তার পরও হাজার হাজার মানুষ এখানে ঘুমাতে আসে। অনেকেই হয়তো কাজ করেন অথবা ব্যাবসা করেন কিন্তু থাকেন বিনা পয়সায় এই পান্তানেল্লা বিল্ডিং এ। আমি ও বন্ধুরা মিলে মাঝে মধ্যে দেখতে যেতাম। সেখানে গেলে আরো নতুন নতুন বন্ধুদের দেখা মিলতো। সবার কাছে হয়ে উঠলো এক পরিচিত নাম। পরিচিত জায়গা পান্থানেল্লা।
গল্প শুনেছি হোসেন ভাই নামের এক লোক বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হয়ে ইতালীতে লোক পাঠাতেন। আর বলতেন, পান্থান্ল্লা তার নিজের বিল্ডিং বিনাপয়শায় থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। সেই সময় হোসেন ভাই নামের সেই লেকের মাধ্যমে এবং অন্যান্য লোকের মাধ্যমে প্রচুর লোক ইতালী এসেছেন।
বিল্ডিং কর্তিপক্ষ এই সব লোকদের নিয়ে পরেগেলেন মহা বিপদে। কেননা এই সব লোকদের সাহায্যের জন্য ইতালীর বিভিন্ন মানব অধিকার সংস্থা গুলি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো। আশ্রিত মানুষ গুলি আরো ভরসা পেতে লাগলো। মানব অধিকার সাহায্য কারী সংস্থা স্থানীয় লোকদের সহযোগিতা আসতে থাকে। কখনো কম্বল, কখনে খাবার নিয়ে হাজির। এভাবেই বেশ কয়েক মাস চলে গেল।
বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন নেত্রীবর্গরা ও এখানে আশ্রয় নেওয়া লোকদের সহযোগিতা করার জন্য কাজ করতে লাগলেন। দিনের চেয়ে রাত হয়ে উঠলো এই এলাকার প্রাণ। সন্ধ্যার পর থেকে জমে উঠতে থাকে লোকের সমাগম। বাংলাদেশ সমিতির প্রায় সব নেতাদেরই এখানে পাওয়া যেতো। সকলের সহযোগিতা করার জন্য চেস্টার ত্রুটি নেই। নেই আন্তরিকতার অভাব।
বিল্ডিং কর্তিপক্ষে স্বাভাবিক ভাবে চেস্টা করে এদের এখান থেকে সরাতে ব্যার্থ হয়ে আইনের আশ্রয় নেয়। বেশ কিছিু দিন আইনি লড়াই এর পর কোর্টের রায়ে এই বিল্ডিং তাদের নিয়ন্তনে নিতে পারে। এটাও সহজ ছিলো না। এই বিল্ডিং থেকে এই লোক গুলিকে অন্যত্র থাকার ব্যাবস্থা করে।শহরেরঅন্যত্র স্থান করার অনুমতি ও স্থান দিয়ে এ বিল্ডিং খালি করতে পারেন।
এক দিন সকালে বেশ কিছু বড় বড় বাস এসে বিল্ডিং এর সামনে হাজির কোর্টের রায় হাতে মালিক পক্ষ। পুলিশের ঘোষনা এই খানে যারা আছেন । তারা অতি তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে আসেন । আজ এই মূহুর্ত থেকে কেউ এখনো থাকতে পারবেন না। আপনাদের কে ভিতেরভো সহ রোমের আশেপাশের শহর গুলিতে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। যারা যারা ইচ্ছুক যেতে পারেন । আর যদি না যান তবে আপনার পছন্দ মত যে কোন জায়গায় যেতে পারেন। অার যারা আইন ভজ্ঞ করবেন তাদের জন্য রয়েছে সোজা জেলখানা।
টি অপশম বা রাস্তা
১/ সাহায্যকারী সংস্থা এবং সরকার রোমের আশেপাশের শহরে থাকার ব্যবস্থা। যারা যাবেন তাদের সমস্ত দায় দায়িত্ব ইতালীয়ান সরকারের।
২/ আপনি না গেলেও আপনার পছন্দমত যে কোন জায়গায় যেতে পারেন।
৩/ কোন রকম বিশ্রিংখলা করলে, আইনি কাজে বাঁধা দিলে সোজা পুলিশের বড় ভ্যানে করে জেলখানা।শুরু হলো দৌড়াগৌডি । এলেন সব নেতা কর্মী, সাহায্য কারী সংস্থা। কিন্তু আইনের কাছে সবাই পরাজিত। অনেকেই বড় লাক্সারী বাসে করে চলে গেলেন ভিতেরভো সহ আশেপাশের অচেনা সেই সব শহরে। অনেকেই তাদের জিনিসপত্র নিয়ে ছুটে গেলেন প্রিয় বন্ধুর বাসায়। অবশ্য বেশ কয়েক জন সেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
সেদিন যারা বাসে করে গেছিলেন তারা সবাই ভাগ্যবান। তাদের জন্য থাকা খাওয়া সব সরকারের দায়িত্বে। কাগজ করা অতি সহজ হয়েছিলো। কাজ থেকে সব কিছুই তাদের তাদের সবার হাতের নাগালে। সেই দিন বাংলাদেশী সহ সব দেশের মানুষ রোম থেকে ছড়িয়ে পরলো বিভিন্ন শহরে। ছড়িয়ে পরলো বিস্তার। আর যারা সেদিন পান্তানেল্লা থেকে বন্ধুদের বাসায় উঠছেন। কিছু দিন থাকার পর নিজেরাই নিজেদের রাতের উপর দাঁড়াতে শুরু করলেন। অনেকেই নামে বাসা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খালি হয়ে গেল পান্থানেল্লা। জনসমুদ্র হয়ে গেল জনশূন্য। এই বিল্ডিং এ এতদিনের স্মৃতি ফেলে চলে যাচ্ছেন। বাসে উঠলেও পিছনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। মাত্র একদিন আগেও এই বিল্ডিং এ একটি সিটের জন্য কতনা চেস্টা। কতনা কস্ট । মূহুর্তের মধ্যেই সব কস্ট সব চেস্টা কোথায় যেন হাডিয়ে গেলো।এখানেও ছিলো নেতৃত্বের লড়াই । যার জোর বেশী সে প্রাধান্য পেতো কিন্তু কোর্টের রায়ে সব নেতৃত্বই যেনো মলিন হয়ে গেলো। পুলিশের বাঁশির হুইচেল, মাইকিং সাথে মানুষের ডাকা ডাকি সব মিলিয়ে এক হূলুস্থল ব্যাপার। কেউ আর এই বিল্ডিং এ থাকতে পারেন না এটা যখন সবাই নিস্চিত হয়েছেন। তখন যার যার সিদ্ধান্ত ।কে যাবেন? কে যাবেন না? অতি তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার। এ সময় রাস্তার অপর পাশে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি।
যারা যারা বাসে উঠলেন। তারা বাসের জানালা দিয়ে অপর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন। এক এক করে সবাই বিল্ডিং থেকে বাধ্য হয়ে নেমে আসতে লাগলেন। কেউ বাসে উঠছেন আবার কেউ রাস্তার অপর পাশে এসে বন্ধুদের খুঁচ্ছেন। যে বন্ধু পেয়ে গেলেন তার মুখে ফুটে উঠলো আনন্দের হাঁসি। এক এক করে সবাইকে নামানোর পর পুলিশের শেষ মাইকিং। যখন দেখা গেল আর কেউ নেই। তখন এই পরিত্যক্ত বিল্ডিং এর কর্তিপক্ষের হাতে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে একের পর এক বাস ছেড়ে যাচ্ছে। উপস্থিত সবাই হাত নেরে বাসের সেই লোকদের কে বিদায় জানাচ্ছেন।
