ফেলে আসা ইতালী,স্মৃতির পাতায়, রংগীন দিন। (পর্ব -৯)

কাজের জন্য ঘুরছি। এক রেস্টুরেন্ট থেকে অন্য রেস্টুরেন্ট ।এক হোটেল থেকে অন্য হোটেল। কাজ পাওয়া সত্যিই দু:সাধ্য ব্যাপার। তবু চেস্টার ত্রুটি নেই। প্রতি দিনই কাজের জন্য ঘুরছি। এর মাঝে বাসার প্রায় সবাই কিছু না কিছু করছেন। আমি শুধু দুদিন সকালে কারিতাসের স্কুলে ক্লাস করি আর বিকেলে এক রেস্টুরেন্ট থেকে অন্য রেস্টুরেন্টে । এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে এক এরিয়া থেকে অন্য এরিয়ায়।
একটি সুবিধা মাসিক বাস টি কিট রোমের যে কোন প্রান্ত যাওয়া যায় আমি রোম শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। আল্লাহ যা করেন মানুষের মংগলের জন্য করেন। আমরা হয়তো বুঝতে পারিনা। সেই সময় আমি বাসে করে কাজ খুজেছি এবং রোম শহরের সুন্দর সুন্দর ঐতিহাসিক স্থান গুলি দেখেছি। কিরন বিয়াই একদিন এসে বললেন “চলেন যাই ডান্ডা মারি। আমি সব কিনে নিয়ে এসেছি”। আমি বললাম “না আমি যাবো না আমার দাঁড়া এটা হবেনা,”।
কিরন বিয়াই আবারো বললেন,” এটা বিদেশ কেউ কিছু মনে করবে না”। আমি বললাম আমার দাঁড়া হবেনা , আমি পারবো না সবার দাঁড়া সব কিছু হয় না। আমার দাঁড়া হবে না। আমি গেলাম না কিরন বিয়াই একাই গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ও পারেন নি। তার দাঁড়া ও হয় নাই। সবার দাঁড়া সব কিছু হয় না।
মোল্লা ভাইর বাসায় থাকেন আমাদের মানিকগন্জের শাখাওয়াত মোল্লা ইয়া মোটা ,ইয়া বড় পেট।কাজ করেন কাজ করেন বললে ভুল হবে। তেলের পাম্পে সেফ সার্ভিস করেন। পাম্পে সেল সার্ভিসে গাড়ী তেল নিতে আসলে গাড়ীতে তেল ভরে দিয়ে হাতটি লম্বা করে বাড়িয়ে দেন গাড়ীর ড্রাইভার বা মালিক কিছু ভাংতি পয়সা বকসিস দেন। শাখাওয়াত ভাই আমাকে বললেন চেলেন আমার সাথে কাজ করবেন।কয়েক দিন বললেন আমি যাই না। কারন আমার কাছে ভালো লাগেনা একদিন রাগ করেই বললেন ,”খালি চাকরী চাকরী করেন, চাকরী কি হাতে মুয়া, চাইলেই পাবেন,”। আরে বললেন কতজন আমাকে অনুরোধ করে আমি নেই না আর উল্টো আপনাকে অনুরোধ করি আপনি যান না। বাধ্য হয়ে একদিন রাতে গেলাম । কয়েকটি গাড়ীতে তেল দিলাম কিন্তু তাদের ব্যাবহার দেখে তেল দেওয়া থেকে পাশে গিয়ে বসে রইলাম। এটাও আমার দাঁড়া হলো না।অথচ এই পাম্পে সেল সার্ভিসে কাজ করে অনেকে অনেক অনেক টাকা রোজগার করেছে।
ঢাকার নাসির ভাই বয়সের দিক থেকে অনেক বেশী তারপরও এসেছেন ইতালী তিনি ও থাকেন আমাদের সাথে তিনি খুব সকালে চলে যান রোমের একটু বাইরে যেয়ে আসন্দিনী ফাসোলিতি বিক্রি করে বেশ ভালো ব্যাবসা করেন।খুব ভোরে চলে যান ব্যাবসা করে আবার দুপুরে এসে খেয়ে দেন লম্বা ঘুম। ঘুম থেকে উঠে আবার সন্ধ্যায় চলে যান সেই মরক্কীর বাসায় মালপত্র কিন্তে। একদিন আমাকে বললেন ,ভাই চলো আমার সাথে তোমাকে কিছু মালপত্র কিনে দেই। ভালো করতে পারবে,আরে লজ্জার কিছু নাই। আমরা সবাই করছি”। তার অনুরোধে গেলাম তার সাথে, নাসির ভাইকে দেখে মরক্কী তো খুসি। পরিচিত কাস্টমার তিন/চার কার্টন ফাসেলোতি বক্স এবং কয়েক ডজন আসোন্দিনী কিনলেন।
একা নিয়ে বাসে উঠা বেশ কস্টকর। ভিয়া কাসিলিনায় ১০৫ নং বসে এমনিতে সব সময় ভীর তার উপর এত গুলি কার্টোন নিয়ে বেশ যুদ্ধ করেই কাসিলিনা বাসে চলাচল করতে হয়।আমি মাত্র দুই কার্টন ফাসেলতি এবং দুই ডজন আসেন্দানী কিনলাম “ অবশ্য মরক্কী আমার কম মালপত্র কিন্তে দেখে বিরক্ত হয়েই বললো, “তু ছেই পাউরা, প্রেন্দি তান্তি, ভেন্দি তান্তি”। আমি বললাম, “প্রিমো জরনো, ইউ সোনো প্রভো”। নাসির ভাইর সাথে সাথে খুব কস্ট করেই বাসে উঠলাম। নাসির ভাই সেই শীতের সময়ও পুরো ঘেমে গেলেন সেদিকে অবশ্য তার খেয়াল নাই । আমাকে বললেন, ভাই ঠি ক আছোতো? আমি বললাম ঠি ক আছি। বাস থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত যেতেও বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। এখানেও দুই হাতে কার্টন কিছুক্ষন পর পর রাস্তায় নামিয়ে আবার হাত বদল করে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় উঠলাম দুজনে।বাসায় ডুকেই কেরিডোর দিয়ে রুমে যেতে ধাক্কা খেলেন দরজার সাথে ব্যাথা পেলেন কিন্তু কিছুই বললেন না। খাটের পাশেই খুব যত্ন করে কার্টোন একটার উপর একটা রেখে দিয়ে। শান্তির নি:শ্বাস নিলেন।
আমি অবশ্য কড়িডোরের পাশেই রেখে দিলাম। খুব ভোরে আমারে ডেকে উঠালেন, বললেন ভাই চলো, আমিও চোখ মুছতে মুছতে মজার ঘুম ছেড়ে উঠে পরলাম। ঝটপট রেডী হয়ে নাসির ভাইর সাথে সাথে চললাম। স্টেশনে টের্মিনির এক পাশ থেকে ব্লু রংগের বাসে উঠলাম। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর নেমে পরলাম দুজনে । একটু হেঁটেই একটি সিগনাল ভাই বললেন তুমি এখানেই শুরু কর। তিনি আমারে বুঝিয়ে দিলেন।এক ডজন আসন্দানী রাখার জন্য একটি কেস ছিলে সাঁরি বদ্ধ ভাবে সাজালাম। এবং ফাসেলতির কার্টন খিলিয়ে দুইটি প্যাকেট হাতে নিলাম। এবার সিগনালে গাড়ী এসে থামলো আমি দুই গাড়ীর মাঝখান দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবং বলতে লাগলাম “মিলালিরে”, মিলালিরে”।
নাসির ভাই কিছুক্ষন দাড়িয়ে দেখে বললেন, তুমি এখানে ব্যাবসা করতে থাকো পাশের সিগনালে তিনি গেলেন। দুই/তিন ঘন্টার মধ্যে আমার এখানে চলে এলেম। হাত শূন্য। আমিতো অবাগ। কার সব মালপত্র বিক্রি হয়ে গেছে অথচ আমার মাত্র কয়েকটি বিক্রী হয়েছে। আমার বিক্রি হয় না আর আমার বিক্রি না হলে নাসির ভাই বাসায় যেতে পারছেন না। কিছু ক্ষন অপেক্ষার পর আমার ঐ সিগনালেই নাসির ভাই আমার মালপত্র হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন।তাজ্জব ব্যাপার মূহুর্তের মধ্যেই বেচা শুরু হয়ে গেল অল্প ক্ষনের মধ্যে সব মালপত্র বেচা শেষ। নাসির ভাইর কাছ থেকে কেনে কিন্ত আমার কাছ থেকে কেনে না। ব্যাবসা আমার কখনো হয় নাই। এখনো হয় না। বারবার চেস্টা করেছি। ফেইল করেছি। যতবার করেছি লসের খাতায় নাম লেখিয়েছি। সবার দাঁড়া সব কিছু হয় না আমার দাঁড়া ব্যাবসা হচ্ছেনা।
