ফেলে আসা ইতালি ! স্মৃতির পাতায় রঙিন দিন ।। 2
সেই দিন সন্ধ্যাটি মনে পরে বাস স্ট্যান্ডের মাঝেই ছিলো মেট্রোতে প্রবেশের একটি গেইট। এই গেইটের আশেপাশেই বাংলাদেশীদের প্রথম মিলন কেন্দ্র। বিকেল হলেই এক এক করে সবাই এখানে চলে আসতেন। এর পাশেই ফিলিপাইন রা খাবার বিক্রি করতেন। সে খান থেকে বাংলাদেশীরা খাবার কিনে খেতেন। এছাড়া স্টেশনের পাশে পিচ্চার দোকান গুলি বাংলাদেশী কাস্টমারে উপচে পরা ভীর থাকতো । তখন পুরাতন বাংলাদেশীদের বাসার সংখ্যা ছিলো খুবই কম। তবে যে কয়টি বাসা ছিল প্রতি বাসাতেই ছিলো নতুন মানুষদের ভীর । ২/৩ রুমের বাসায় যেখানে থাকার কথা ৪/৫ জনের সেখানে থাকতেন ১৫/২০ জনের বেশী থাকতেন ।
আমি সব সময় একটু ভাগ্যবান বলতে পারেন। অনেকে বাসায় জায়গা না পেয়ে হোটেলে থেকেছে। পয়সা শেষ হওয়ার পর কারাতাস সহ বিভিন্ন সংস্থায় থেকেছেন। শুনেছি অনেকে গীর্জায় কিম্বা পার্কেও ঘুমিয়েছেন। আমি উঠলাম মোতালেব মোল্লার বাসায়।বাসা স্টেশনের খুব কাছেই । মনে পরেছে ভিয়া – ফিলিপ্পো তুরাতি ৮৬। নতুন নতুন মানুষের মাঝে নিজেও হারিয়ে গিয়েছিলাম। কিছু ক্ষন পর মেঝ ভাই এসে আমাদের নিয়ে গেলেন।আমার সাথে ছিলো আমার বিয়াই মেঝ ভাইর সালা কিরন শিকদার। কিরন বিয়াই, ইয়াকুব ভাই, রবিউল ভাইও সাথে এলেন। মেঝ ভাই সব সময় বন্ধু বান্ধব নিয়ে চলেন তার সাথেও ছিলেন আলহাস খন্দকার, সালেহ আহমেদ , ওয়াসিম ভাই, শাহজাহান মোল্লাহ সহ আরো বেশ কয়েক জন।
সবাই একটি কাজের উদ্দ্যেশ্যে এসেছেন সেটা হলো ইতালীর কাগজ। এই পেরমেচ্ছো দি সোজর্ন যেন সোনার হরিণ। যে কিছুর বিনিময়ে এটাকে পেতেই হবে। সেই সময় নিয়ম টি ছিল আপনাকে ১৯৮৯ সালের পূর্বের একটি প্রমান পত্র। সেটা হতে পারে একটি চিঠি, হতে পারে বাস টিকি ট, হোটেলের রিছিপট, কারেন্ট বিল বা গ্যাস বিল, অথবা স্কুল বা কলেজের ভর্তির সার্টিফিকেট , স্টেডিয়ামে খেলা দেখার টিকি ট, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ইতালীর একটি আইডি কার্ড অথবা সার্টিফিরেট আর বাংলাদেশ এম্বাসির কোন লেটার , ব্যাংক একাউন্ট হলে আরো উত্তম কিম্বা ব্যাক ডেটের যে কোন প্রমান অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে আপনি যে ইতালী ছিলেন তার যে কোন একটি প্রমান।
এই একটি প্রমান সংগ্রহের জন্য হন্ন্য হয়ে ঘুরছে এখানে সেখানে। একটি পুরাতন ডকুমেন্টের যে কত দাম তখন কার যারা ভুক্তভোগী শুধু তাঁরাই জানেন।একটি পুরাতন চিঠি কত যে মূল্যবান । অনেকে তাদের বন্ধুদের বিনা মূল্যে দিলেও কেউ কেউ নিয়েছেন চড়া দাম। প্রথম প্রথম সহজ হলেও দিন যত যায় ডকুমেন্টের জন্য হা হা কার তত বাড়তে থাকে। কসতুরায় বা থানায় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ইতালীর সদস্য কার্ড দিয়ে অনেকেই কাগজ পেয়েছেন। আর এজন্যই বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের এত মূল্য। একটি আইডি কার্ড অথবা সার্টিফিকেট হলেই পেয়ে যাবেন স্বপ্নের কাগজ।
এই একটি কাগজের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে এসেছেন ইতালীর রাজধানী রোমে অন্যান্য শহর গুলিতে কাগজ জমা নিলেও রোম এ্যাম্বাসীতে পাসপোর্ট করতে আসতেই হবে। আর সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা যেহেতু এই শহরে তাই সবার গন্তব্য রোম শহরে। ইউরোপের দেশে যেসব বাংলাদেশীরা থাকেন তারাতো এসেছেন। সেই সাথে বাংলাদেশ থেকে নতুন লোক আসার হিড়িক পরে গেলো। লোক অার লোক শুধু যে বাংলাদেশী তা নয় পৃথিবীর সব দেশের লোকের একটাই গন্তব্য ইতালীর রোম। একটাই উদ্দেশ্য কাগজ।
পরের দিন বিকেলে আমি আর কিরন বিয়াই হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম স্টেশনে টেরমিনির সেই পরিচিত জায়গায়। যেখানে এলে নতুন পুরাতন সবার সাথে দেখা হবে কথা হবে। সবার উদ্দ্যেশ্য যখন এক তখন আলোচনাও এক ঘুরেফিরে একই আলোচনা। কে কাগজ জমা দিয়েছে? কে জমা দিবে? কে কে চিঠি বা ডকুমেন্ট সংগ্রহ করতে পেরেছেন? কে কোথায় উঠেছে? কে কোন বাসায় উঠছেন? কোন বাসায় ছিট আছে? এই নিয়েই আলোচনা। সে আলোচনা শুনতে ভালো লাগে। বাসা নিতে হবে । কাগজ করতে হবে। বৈধ ভাবে থাকতে হবে রোমে টাকা কোন ব্যাপার না।
সেই দিন বাংলাদেশ সমিতি ইতালীর বেশ কয়েক জন কর্মকর্তাদের দেখলাম তারা খুবই ব্যাস্ত। একটি ফাইল হাতে একটি লোক সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে সাথে সাথে অনেক গুলি লোক নামছেন। মুখে গোঁফ ছিপছিপে গঠনের একজন পাশ থেকে বললেন চিনেননা? আমি মাথা নাড়ালাম না। আমি নতুন এসেছি। তিনি বললেন আরে মিয়া “ইনি হচ্ছেন লুৎফর রহমান বাংলাদেশ সমিতি ইতালীর সভাপতি। উনার অনেক ক্ষমতা”। আমি আর কিরন একটু দূর থেকে দেখছি। সালাম দিবো কিন্তু কাছে যেতে পারি নাই। দূর থেকে শুধু দেখছি। সবাই কথা বলছেন ফাইল থেকে একটি ডাইরি বের করে নাম ঠি কানা লিখছেন আবার অনেককে সার্টিফিকেট বা আই ডি কার্ড দিচ্ছেন। যে পাচ্ছেন সেতো মহা খুশি।
সিঁড়ির উপরে উঠতেই দেখি একটি ভেস্পা হোন্ডা করে একজন নামলেন। এর আগেই অনেক লোক অপেক্ষা করছিলেন। নামার সাথে সাথে তারে সবাই ঘিরে ফেললো। সেই একই অবস্থা পরে জানতে পারলাম ইনি হচ্ছেন বাংলাদেশ সমিতি ইতালীর সাধারন সম্পাদক হেনড্রী দি কস্তা। অপর পাশে কিছু লোকের জটলা সেখানে গেলাম সেখানে সহ সভাপতি এ কে এম লোকমান হোসেন। বাসার দিকে আসতেই আরো অনেক লোকের জটলা সেখানে গেলাম তিনি হচ্ছেন সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম কিবরিয়া। এদের সবাইকে দেখছি আর অবাগ হচ্ছি। প্রবাসে এসেও শত ব্যাস্ততার পরও বাংলাদেশীদের সহযোগিতা করার জন্য একটি সামাজিক সংগঠন এবং সেই সংগঠনের প্রায় সব কর্মকর্তাই তার অবস্থান থেকে নতুন দের সাহায্য সহযোগিতা করে আসছেন। সংগঠনের কর্মকর্তা ছাড়া ও যে যেভাবে পারছেন সাহায্য করে যাচ্ছেন।
এতো লোকের মাঝে ঘুরতে ঘুরতে আমার দুজন পরিচিত পুরানা বন্ধু পেয়ে গেলাম। একজন নুরুল আফসার হিরন মিরপুর বাংলা কলেজে ডিগ্রীতে পড়া র সময় পরিচয় এবং অপর জন ও বরিশালের হিরন ভাই দুজনের সাথে ঢাকার মিরপুর মেসে থাকতে পরিচয়। দীর্ঘ দিন পর রোমে এদের পেয়ে সে কি আনন্দ।