| | | |

ফিরে দেখা ২০২৪। স‍্যার কি দেশ ছাইড়া ভাগাচ্ছেন ।


মোঃ রেজাউল করিম মৃধা।

২০২৪ সাল ছিলো আমার জীবনের সাফল্যের এক মাইল ফলক। পবিত্র হজ্জ্ব পালন, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের সেরা কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পুরস্কার। এলবিপিসি নির্বাচনে বিজয়ী, টিকটক এর একটি ভিডিও ৫০০,০০০ বেশী ভিউ, নিজ গ্রামে মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু, ছাত্র বৈষম্য আন্দোলনে শেখ হাসিনার পলায়ন এবং ছাত্র জনতার বিজয়, সেঁঝো মেয়ের এ লেভেল পাশ সহ নানা সফলতা এনে দিয়েছে।

কঠোর পরিশ্রম, সততা, নিষ্ঠা,আন্তরিকতা এবং আপনাদের দোয়া, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা আমার সফলতা চাবিকাঠি। আমি ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমি মানুষ। কোন কিছুই বাঁধা মনে করিনা। কাজ করি আপন মনে। শত কস্ট হাসি মুখে উড়িয়ে দিয়ে কমিটমেন্ট সব সময় প্রাধান্য দেই।

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসটি ছিলো সব চেয়ে চ্যালেঞ্জিং লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের নির্বাচন। পারিবারিক কাজ ও আইডি কার্ড বানাতে আমার স্ত্রী ছিলেন দেশে। এক দিকে ছেলে মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, রান্না করা, ইউটিউব এ নিউজ তোলা, নির্বাচনী ক‍্যাম্পেইন আর চ‍্যানেল এস এর ডিউটি তো আছেই। 

সব মিলিয়ে এক মিনিটও সময় নেই হাতে। সব কিছু তাল মিলিয়ে চলতে সেই রকম পরিস্থিতি। কিন্তু আমি তো পিছনে ফিরে তাকাইনি। পিছনে ফিরে তাকানোর মানুষ নই।একের পর এক রুটিন মাফিক কাজ করেছি আর আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে হয়েছি নির্বাচনে বিজয় হয়েছি সব কস্ট নিমিষেই চলে গেছে। আপনাদের এতো এতো ভালোবাসা পেয়েছি। আপনাদের ভালোবাসায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি। 

ফেব্রুয়ারি আমার জন্ম মাস এ মাসেই আমার জন্ম। তাই বিশেষ আয়োজন থাকে পরিবারের পক্ষ থেকেও।শহীদদের স্মরণে আলতাব আলী পার্ক চ‍্যানেল এস এর ফুল বানানোর দায়িত্ব বেশ কয়েক বছর ধরেই আমার হয়েছে।সকালে বানিয়ে ফেলি। এবারও তাই বাসার পাশেই লিডিল মার্কেট থেকে ফুল কিনে অফিসে গিয়ে বিশাল ফুলের তরুণ বানিয়ে ডিউটিতে চলে আসি।

এবার ব‍্যাতিক্রম কাজ হলো প্রেস ক্লাবের ফুলের তোড়ণ বানানো। তখন রাত ৯.০০টা বাজে। আমরা ইসি কমিটির মিটিং এ বসেছি। তখন ফিস ফিস শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়বার নির্বাচিত ট্রেজার সালেহ আহমেদ সালে ভাই দায়িত্ব নেন নি।ফুলের  দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নবনির্বাচিত নির্বাহী সদস্য ফয়সাল মাহমুদকে। তিনি রাত ৯.০০টায় খালি হাতে এসে জেনারেল সেক্রেটারি তাইসির মাহমুদের কাছে কানে কানে ফিস ফিস করে বলছেন কোথায় ফুলের দোকানে অর্ডার দেওয়া যায় নাই। তিনি অর্ডার দিতে পারে নাই।রাত ১২.০১ মিনিটে শহীদ আলতাব আলী পার্কে ফুল দিতে হবে। কমপক্ষে ১১.৩০ পার্কে চলে যেতে হবে। কিন্তু ফুল নেই। নেই ফুলের তোড়া। ফিস ফিস করতে করতে প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে।

আমি নিজে থেকে বললাম কি হয়েছে ঘুসুরমুসুর করতেছেন কেন? তাইসির ভাই বললেন ফুল তো ব‍্যাবস্থা হয় নাই। আমি বললাম কোন চিন্তা করবেন না। ইন্সা আল্লাহ ব্যাবস্থা হবে। সেই সাথে বললাম একজন আমাকে হেল্প করতে হবে। এখন একে অন্যের দিকে তাকায়! কি আশ্চর্য আমি আবারও বললাম একজন মানুষ আমাকে হেল্প করবেন। তখন এ‍্যাসিস্টটেন্ট ট্রেজারার ইব্রাহিম খলিল ভাই আমার সাথে এলেন। প্রেস ক্লাবের অফিস থেকে অচেনা উদ্দেশ্যে বের হলাম। জানিনা কোন দিকে যাবো। ব্রিক লেইনে এসে বললাম ইব্রাহিম ভাই কোন দিকে যাবো? উদ্দেশ্য ফুল কিনে ফুলের তোড়ণ বানানো। ইব্রাহিম ভাই বললেন হাতে ডাইনে। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিক লেইন শেষে সটইজের কাছে সেইন্সবেরি সুপার মার্কেটে ঢুকে ফুল যা ছিল সব নিয়ে নিলাম। সুতা, তাঁর,কাঁচি ও দুইটি লাঠি কিনে নিলাম আর রাস্তায় পেয়ে গেলাম বোর্ড এ যেনো “সোনায় সোহাগা”। অফিসে যাওয়ার পূর্বে ব্রিক লেইন মসজিদের পাশে একটি শপ থেকে হাতুড়ি তারকাটা এবং স্কস নিয়ে অফিসে ফ্লোরে বসে সুন্দর ফুলের বিশাল একটি গোলাকার বানালাম হাত লাগালেন নির্বাহী সদস্য পলি আপা। তাইসির ভাই অনেক কস্টে একটি সাদা কালো প্রেস ক্লাব লেখা প্রিন্ট করলেন কেননা ১০ টা অনেক বেশি বাজে সকল প্রিন্টার বন্ধ।শেষ মুহূর্তে ফুলের তোড়াটি শহীদ মিনারে শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হলো।

মার্চ মাস আমার ছেলের জন্মদিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিবস এ মাসটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই ভাবে প্রতিটি মাস আমার জন‍্য অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহন করে।

 জুন এবং জুলাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। পবিত্র হজ্জ্ব পালন, মক্কা, মিনা, আরাফাতের ময়দানে ও মদিনা শরীফে অবস্থান জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

হজ্জ্বে যাই যাই করে ও যাওয়া হয়ে উঠে নাই। বা আল্লাহর হুকুম হয় নাই। এবার হঠাৎ করেই আল্লাহ সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ করে দিলেন।

প্রবাসী হয়ে নিজে একটু স্বাবলম্বী হয়েই বাবাকে হজ্জ্বে পাঠিনো।এর দুই বছর দেশে গিয়ে বিয়ে তারপর কয়েক বছর পরে স্ত্রীকে ইতালী নিয়ে আসা ছেলে মেয়ে সংসারে একরের পর দায়িত্ব বেড়ে চলা অন‍্যান‍্য ঝামেলা তো থাকেই। 

এরপর ইতালী ছেড়ে লন্ডনে এসে স্থায়ী হওয়া। কাজ বাসা সব মিলিয়ে নতুন দেশ নতুন পরিবেশে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়া।বড় মেয়ে ও মেঝ মেয়েকে বিয়ে দেওয়া সব মিলিয়ে দায়িত্ব যেনো বাড়তেই থাকে। 

কিন্তু মনে মনে সব সময় নিয়ত ছিলো হজ্জ্বে যাবো আল্লাহ কখন কবুল করবেন সেই অপেক্ষায় আল্লাহর হুকুম না হলে হজ্জ্বে যাওয়া সম্ভব নয়। হজ্জ্বে যাওয়ার টাকা আগে সন্চয় করেছিলাম। 

অবশ্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পবিত্র উমরাহ করে এসেছি। আমার নিয়ত আল্লাহ কবুল করেছেন। তাই এবছর হজ্জ্বে যাচ্ছি ইন্সা আল্লাহ।

হঠাৎ অনলাইনের একটি নিউজ চোখে পড়লো হজ্জ্ব আবেদনের বা হজ্জ্ব ২০২৪ এর বুকিং ৫ই ফেব্রুয়ারি শেষ। আমার স্ত্রী তখন দেশে। তার সাথে হজ্জ্ব সম্পর্কে আলাপ করাতে তিনি যেনো আকাশ থেকে পরলেন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারে নাই হজ্জ্বের যাবো। আমি অবশ্য বহু আগে থেকেই মানুষিক ভাবে প্রস্তুতি ছিলাম শুধু সময়ের অপেক্ষা কখন আল্লাহ কবুল করবেন?

আমার স্ত্রী কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বললেন কি ভাবে সম্ভব ? আমি বললাম যা প্রথম প্রয়োজন ছিলো সেইটা হয়েছে। এখন তোমার অনুমতি হলেই আমি হজ্জ্ব এজেন্সির সাথে কথা বলবো?  অবশ্য আমার স্ত্রী চেয়ে ছিলেন আরো বয়স বেশী হলে তিনি যাবেন। আমি বললাম তা হলে আমি একা যাই তিনি কিছু সময় চুপ থেকে বললেন “না আমি ও যাবো”।

আমি দুইটি হজ্জ্ব ট্রাভেলস এর সাথে ফোনে কথা বলি একটি থেকে গত কয়েক বছর আগে আমার শাশুড়ী, শালা , মামা শশুড় , মামী শাশুড়ী সহ এক গ্রুপে গিয়েছিলেন।তাদের সাথে কথা বললাম সেই সাথে আমার বন্ধু ওয়াজেদ মোল্লা তিনিও কয়েক বছর আগে হজ্জ্ব করে আসছেন। এবার দেশে যাওয়ার পর ওয়াজেদের সাথে আমাদের গ্রামের একটি অনুস্ঠানে ছিলাম আলাপ প্রসংগে হজ্জ্বের কথা উঠেছিলো। তখন বলেছিলো এই হজ্জ্ব ট্রাভেলসের কথা। 

আমার স্ত্রী রাজি হওয়ার সাথে সাথে ওয়াজেদকে ফোন দিলাম এবং হজ্জ্বের কথা বলার সাথে সাথে ও এতো খুশি হয়েছে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। বললাম দোওয়া করিস এবং হজ্জ্ব ট্রাভেল্সের নাম্বার দে ও নাম্বার দিলো কথা হলো এবং আমার শাশুড়ী যে এজেন্সির মাধ্যমে হজ্জ্বে গিয়েছেন তাদের সাথে কথা বললাম। সব ঠিক হয়ে গেলো। হজ্জের সব ব্যবস্থা। 

বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাপে পুরানা পল্টনের অহি ট্রাভেলস এজেন্সির ডিরেক্টর ওসমান গনি ভাই খুবই ভালো মানুষ কিন্তু ফোনে কথা শেষ করেন না খুব ব্যাস্ত দেখান। বুঝিয়ে বলবেন অথবা পুরো কথাটি শুনবেন এমন নয় কিন্তু এর ফলে আমাদের মত অনেক হজ্জ্ব যাত্রী অসুবিধায় পরতে পারেন আমার মনে হয়।

সর্বশেষ সময় ফোনে বলবেন এখন এইটা লাগবে? আমি কোথায় আছি কি করছি বুঝতে চান না। শনিবার কিম্বা রবিবারও বুঝতে চান না। ধরুন রবিবার ফোন দিয়ে বললেন ফিন্গার প্রিন্ট লাগবে। আমি তখন ডিউটিতে বুঝাইয়া বললেও শুনতে রাজি নন। অবশ্য কাজের ফাঁকেই বাসায় এসে আমারটা আমার মোবাইল ফোনে এবং আমার স্ত্রীটা তার ফোনে ফিন্গার প্রিন্ট সহ সবকিছু করে দিলাম।

জুন মাসের মাঝামাঝি সবাইকে মক্কায় থাকতে হবে। আমাদের ফ্লাইট ছিলো জুন মাসের ৫ তারিখ কিন্তু হঠাৎ করে এজেন্সি থেকে বললো আপনাদের ফ্লাইট ৩ তারিখ। এখন কি করি কেননা আমরা লন্ডন থেকে বাংলাদেশে যাবে তারপর বাংলাদেশ থেকে সৌদিআরব হজ্জ শেষে সৌদিআরব থেকে বাংলাদেশ হয়ে তারপর লন্ডন। আমাদের লন্ডন টু ঢাকা যাতায়াতের আলাদা টিকিট।

যেহেতু ৩ তারিখ আমাদের ফ্লাইট এই জন‍্য অবশ‍্য ২/৩ আগে বাংলাদেশে যেতে হবে। চ‍্যানেল এস এ কাজের থেকে ছুটি নিয়েছিলাম ৪ তারিখ থেকে কিন্তু যেহেতু ৩ তারিখ ফ্লাইট সেই জন‍্য আগে যেতে হবে। এবার গেলাম লাব্বাইক ট্রাভেলসে হিফজুর ভাই প্রায় সময় এই ট্রাভেলস থেকে টিকিট করি। আগের টিকিট করা আছে এখন মে মাসের ২৫ তারিখে পর কোন টিকিট নেই তাই টিকিট করে চ‍্যানেল এস এর হেড অফ নিউজ কামাল মেহেদী ভাই কে ফোন দিলাম ভাই ছুটি আগে থেকে লাগবে। মেহেদী ভাই সাথে সাথেই বললেন হজ্জে যাবেন কোন চিন্তা করবেন না। আপনার সময় মত সব কিছু করেন ধন্যবাদ মেহেদী ভাইকে সহযোগিতার জন‍্য।

অবশ্যই ২৫মে দেশে যেয়ে লাভ হয়েছে। মে মাসের শেষ শুক্রবার গ্রামের বাড়ির মসজিদে জুম্মার নামাজের জন‍্য আমরা তিন ভাই বহুদিন পর একসাথে গ্রামের বাড়িতে যাই। নামাজ শেষে মসজিদ নতুন বিল্ডিং এর কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে ভাবে উদ্বোধন করা হলো। আল্লাহ যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন‍্য করেন।

হজ্জ্বে যাওয়ার পূর্বে টিকা দেওয়া সহ অন্যান্য কাজ করা হলো রবিবার বড় ভাইয়ের বাসায় ভাইবোন, ভাগ্নে ভাগ্নি, ভাতিজা ভাতিজি, নাতি নাতনি সহ সবার সাথে দেখা বিদায় নেওয়া। 

সেই সময় মা এবং বাবাকে বেশী মনে পরতে লাগলো। নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না। পরদিন টিকার রেজাল্ট নিয়ে মা বাবার কবর জিয়ারত করে দোওয়া করে এসেছি। মক্কা, মদিনা সহ সব খানে মা বাবার জন‍্য দোওয়া করেছি এখনো দোওয়া করি আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাত নসিব দান করেন।

মা কে বেশি মনে পড়ে । মা বেঁচে থাকলে হজ্জ্বে যাওয়ার খবরে বেশী খুশি হতেন। বাবাও হতেন কিন্তু মা প্রাণভরে দোওয়া করতেন মাথায় পিঠে কতবার হাত দিয়ে আদর করতেন! আহ সেই পরশ সেই আদর আর কেউ করে না।ছাত্র জীবনে বাড়ি থেকে কলেজ যাওয়ার সময়, দেশে থেকে বিদেশে আসার সময় এখনতো হজ্জ্বে যাচ্ছি কতযে খুসি হতেন? কত যে আদর করতেন? 

আমার মনে আছে মায়ের শেষ বিদায়ের কথা। সেই স্মৃতি আজও আমার হৃদয়ে রয়েছে। আমি আসার মাত্র কয়েকদিন পরই মা মারা যান। মায়ের অসুস্থতার সময় আমি প্রতি বছরই মা দেখতে গিয়েছি। সেই বছর দুইবার গিয়েছি। কিন্তু মাকে কবরে দেওয়ার ভাগ‍্য হয় নাই। মা মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আমি লন্ডন থেকে বাসায় না যেয়ে সোজা হাসপাতাল গেলাম। মা বিছানায় শুয়ে আছেন উঠতে পারকেন না।আমার মেঝ বোন সহ আত্মীয় স্বজনরা মার পাশে রয়েছে। আমি যাওয়ার সাথে সাথেই উঠে বসে আমাকে যে আদর করেছে মনে হচ্ছে মা তার সমস্ত ভালোবাসা আদর আমাকে দিচ্ছে। সেই দোওয়া ও ভালোবাসা নিয়েই আমি বেঁচে আছি ।

জুন মাসের ৫ তারিখ থেকে জুলাই মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত মক্কা ও মদিনায় ছিলাম পবিত্র হজ্জ্ব পালনে ছিলাম সব কিছুই সুন্দরভাবে আদায় করেছি দোওয়া করবেন আল্লাহ যেনো হজ্জ্ব কবুল করেন এবং বাকী জীবন আল্লাহর ভালো ভাবে চলার তৌফিক দান করেন ।

১৯শে জুলাই পবিত্র হজ্জ্ব পালন শেষে বাংলাদেশে ঢাকায়  পৌছাম। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত।  এয়ারপোর্ট নামতেই বিভিন্ন খবর কানে ভেসে আসতে লাগলো। সৌদিতে প্রায় দেড় মাস ছিলাম। মক্কা, মদিনায় থাকা অবস্থায় দেশের তেমন খবর নেওয়া হয় নাই।ইবাদাত নিয়েই বেশী সময় পার করেছি। আমি আমার স্ত্রী দুইজনই একসাথে হজ্জ্ব পালন শেষে দেশে ফিরেছি।

ইমিগ্রেশনে বিশাল লাইন। কোন নিয়ম নীতি নাই। হট্টগোল চলছে। হাজী সহ অন‍্যান‍্য যাত্রীরা বলাবলি শুরু করেছে দেশের অবস্থা এবং কে কিভাবে তার নিজের বাড়িতে যাবে? আমি ঢাকার বাড্ডায় ছিলাম। সেখানেই আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র , কাপড় লন্ডনে যাওয়ার সবকিছুই রয়েছে। দেশে যে অবস্থা তাতে কোন ভাবেই বাড্ডায় যাওয়া সম্ভব নয়।

একেবারে এয়ারপোর্ট পাশে নিকুঞ্জ-২ আমার বড় শালার বাসা। সেই বাড়িতে যাবো সিদ্ধান্ত নিওয়া হলো। কি ভাবে যাবো?  এয়ারপোর্ট থেকে বের হলে কি ঝামেলায় পরি কে যানে তাই এয়ারপোর্টে গেইট থেকে বের হওয়ার আগেই একটি রেন্টে কার অফিস আছে। সেখানে তাদের সাথে কথা হলো যা চায় দাম বা টাকা কোন ব্যাপারই না।আমাদের বাসায় যেতে হবে।

এয়ারপোর্টের গাড়ি ভাড়া করে বাসায় চলে যেতে যেতে দেখি রাস্তায় পুরাই ফাঁকা। ইন্টারনেট বন্ধ। শুধুমাত্র ফোন। আত্বীয় স্বজন সবাই ফোন যোগাযোগ। বাসায় যেয়ে ফোন ছাড়া খবর নেওয়ার কোন উপায় নেই। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ কি এক অদ্ভুত কান্ড। দীর্ঘ দিন পর সবাই টেলিভিশনে সামনে  সংবাদের অপেক্ষায় কি ঘটছে এবং কি ঘটবে?

রাত দিন ২৪ ঘন্টা কারফিউ। পরদিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ কিন্তু আমাকে তো বাড্ডা যেতেই হবে। কেননা ব্রিটিশ পাসপোর্ট সহ কাগজপত্র আনতে হবে। খবর দেখছি আর ভাবছি কি করা যায়? দিনের বেলা সকাল ১০.০০ টা থেকে ১২.০০ টা পর্যন্ত মাত্র দুটো ঘন্টা বিরতি আবার কারফিউ। 

এই দুই ঘন্টা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। ফোনে ফোনে অনেকের সাথে কথা হয়েছে কিন্তু কেউ ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে না। মৃত্যুর ভয় । আর বাড্ডার বিশ্ব রোডেই সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক । রামপুরা থেকে উত্তরা পর্যন্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বিদ‍্যালয় আর এই বিশ্ববিদ্যালয় সব আন্দোলন স্থান। 

প্রতিটি মানুষ মৃত‍্যু ভয়ে অস্থির ।মৃত‍্যু ভয় আমার যে নেই তা নয়। তবে আমার বিশ্বাস। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করবেন ।আমি একাই যাবো। আমার সাহস দেখে আমার স্ত্রী ও বললেন আমিও যাবো । তখন আমার শাশুড়ির চোখ কপালে উঠে গেছে। তিনি বললেন” তোর কি যাওয়ার দরকার রেজা গেলেই হবে”। জামাইয়ের চেয়ে মেয়ের প্রতি দরদ বা মায়া বেশী। এইটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

বাসা থেকে বের হয়ে ওভার ব্রিজ পার হয়ে ওপারে খিলক্ষেত গেলাম থমথমে ভাব সেখানে দুইএকটি রিকশা আছে। তবে যাত্রীর সংখ্যা ও কম নয় যে যার অবস্থানে যাবেন তাদের যে যেতেই হবে। আমাদেরও তাই। একটি রিকশা এলে সবাই হমড়ি খেয়ে পরে।আমি বললাম বাড্ডা যাবেন। রিকশাচালক হেসে দিলেন,বললেন আপনি কি জানেন না ঐ রাস্তায় যাওয়া যায় না। যতটুকু যাওয়া যায় চলো। বলে ২০০ টাকা দিবেন। ২০ টাকার স্থানে ২০০ আজ টাকা কোন সমস‍্যা না। আমাদের যেতেই হবে।মোটর চালিত রিক্সা। এয়ারপোর্টে রাস্তায় থেকে বিশ্ব রোড অর্থাৎ রামপুরা রাস্তা যেটাকে প্রগতি স্মরণি বলে।

কুড়িল বিশ্বরোড কিছুটা দূরে আসতেই রাস্তার অবস্থা নাজেহাল। বেরিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার মধ‍্যেই ক্রিকেট খেলা হচ্ছে ছেলেরা। ইচ্ছে করেই অনেক ইচ্ছে করেই পথচারীদের গাঁয়ে বল লাগাচ্ছে। কারো কিছু বলার সাহস নেই। সুন্দরি কাউকে দেখলে সীস দিচ্ছে। ভিন্ন দৃষ্টি ভংগি।যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ডিভাইডার বা আইলাইনার রাস্তার মাঝে দিয়েছে যাতে গাড়ি, রিকসা তো দূরের কথা মানুষ ও হাঁটতে না পারে। রাস্তার যেখানে বেরিকেড দেওয়া সেই খানে নেমে গেলাম। আবারও পায়ে হাঁটা শুরু।

পুরো রাস্তা জুড়ে ভাংচুরের দৃশ্য। বেরিকেড দিয়ে আটকানো। যমুনা ফিউচার পার্ক পার হয়ে কালাচাঁদ পুর যেয়ে আবার একটি রিকশায় কিছু দূর যেতে রাস্তা বন্ধ। আবার হাঁটা শুরু। এবার নতুন বাজার কাছাকাছি যেয়ে আবার রিকশা। একদিকে আমেরিকান দূতাবাস অপর দিকে ভাটারা থানা পুলিশ স্টেশন । ভয়ে ভয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে কখন থামায় কি জিজ্ঞেস করবে? সব যেনো আতঙ্ক। থানায় সামনে রাস্তা পুরোটা বন্ধ আর্মির টহলদার গাড়ি। রিকশাচালক রিকশা বারিধারার ভিতর দিয়ে থানার পিছন দিকের রাস্তা দিয়ে শাহাদাৎ পুর দিয়ে বাড্ডার দিকে যাচ্ছএ। বাড্ডা যাওয়ার প্রগতি সড়ক চলাচল বন্ধ।সুবাস্তর পিছন দিয়ে যেতে যেতেই ফাঁকা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলাম সবাই। অনেকে তাড়াহুড়া করে ছুটাছুটি করছেন। গোলির মাঝখান থেকে কিশোর বয়সে ছেলেরা পুলিশ কে হুর্ররে হু দিচ্ছে। পুলিশ আবার দৌড়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে। এ যেনো সাপ নেইলের লাঠি খেলার মতো ।

উত্তর বাড্ডা বাজারের পিছনের রাস্তা দিয়ে যেতে আবারও কয়েকটা গুলির শব্দ। আমরা রিকশা নিয়ে একেবারে হোসেন মার্কেটের পিছনের রাস্তায় দাঁড়ালাম। শুনেছি বারান্দায় একটি শিশু গুলিতে মারা গেছে কি সেই সব দৃশ্য?

এর আগেই ফোনে ছোট শালা পরাগের সাথে কথা হচ্ছে। উত্তর বাড্ডা কুয়েতি মসজিদ আর হোসেন মার্কেট খুবই পরিচিত। নাম বললেই সবাই চিনে। আজ যেনো এক রনক্ষেত্র। রিকশা রেখে পায়ে হেঁটে বড় রাস্তা প্রগতি স্মরনী পাড় হতে সেই দৃশ‍্য কখনো ভুলার নয়। ভয়, আতঙ্ক, সংঘাত, উপর থেকে ফাঁকা গুলি আওয়াজ। ঠুসঠাস শব্দ। 

এরমধ্যে পরাগ আমাদের দুইজনের পাসপোর্ট সহ অন্যান্য জিনিসপত্র তিনচারটি পলেথিন ব‍্যাগে করে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পাসপোর্ট।এই ব‍্যাগগুলি হাতে নিয়ে পরাগকে বিদায়ের দৃশ‍্য কখনো ভুলে থাকতে পারি না। কে বাঁচবে কে মরবে কেউ জানিনা? সে এক ভয়ংকর দৃশ্য।সে এক রনক্ষেত্র টুসটাস গুলির শব্দ। আতংক ভয়।

বড় বোন ছোট ভাইয়ের মাথা এবং পিঠে হাত দিয়ে দোওয়া করে দিয়ে বললো সাধানে রাস্তা পাড় হয়ে সুজা বাসায় যা। সেই যে মায়া কোন কিছুর বিনিময় পাওয়া যায় না।পরাগ চলে যাচ্ছে এ যেনো পাজড়ের একটি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। যদি বাসায় না পৌঁছায়? তাহলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে আমাদের সহযোগিতা করতে এসে রাস্তায় পরাগের মৃত‍্যু। না আল্লাহর রহমতে পরাগ ঠিকমত বাসায় গিয়েছিলো। 

আমরা সেই রিকশা আবার উঠলাম কেননা রিকশা বিদায় করলে যদি আর একটি রিকশা না পাই। রিকশার সংখ‍্যা খুবই কম। পরাগকে বিদায় দিয়ে আমরা যখন রিকশায় উঠি তখন রিকশাওয়ালা বলেছি” স‍্যার আপনি দেশ ছাইড়া ভাগতেছেন?”। সেই রিকশাওয়ালার উত্তর টা আজও দিতে পারিনি। “শুধু বললাম চলো”।

বাসায় না ফেরা পর্যন্ত একমুহূর্তও শান্তি পাই নাই। রিকশা, হাঁটা রিকশা, পুলিশের মহড়া, আর্মির প্লাটন প্লাটন গাড়ি কি ভায়াবহ পরিস্থিতি? 

হাতে তিনটারটা পলিথিনের ব্যাগ। লোকেরা আর চোখে তাকালেই মনের মধ্যে আরো ভয় জমে উঠে। একটু জোড়ে হাঁটতেই আমার স্ত্রী বলে উঠলেন আমাকে ছেড়ে যেওনা। মনে হয় চাচা আপন জান বাঁচা। লোক হেঁটে যাচ্ছে সবার মনেই আতঙ্ক । “সেই দিনের দুঘন্টা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি”।

সেই দুঘন্টা এক স্মৃতিময়। যা কোনদিন ভুলা যাবে না।

সেই রিক্সা ওয়ালা কথাই সত্যি হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী সহ অনেক নেতাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

পরের দিন লন্ডনের ফ্লাইট। আগেই বলেছি হজ্জ পালন শেষে বাংলাদেশ এবং পরে আবার লন্ডন। টেলিভিশনে খবর শুনলেই মন আৎকে উঠে।দেশের ছাত্ররা একের পর এক জীবন দিচ্ছে। কি হবে কেউ জানে না। আবার দেখতে পাচ্ছি ছাত্রদের সাথে অভিভাবকরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। আন্দোলন বেগবান হচ্ছে। ছাত্র জনতার আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে।

আমার টেনশন অন‍্যদিকে। ফ্লাইট ক‍্যানসেল হচ্ছে কি না? সন্তানের রেখে প্রায় দুই মাস বাইরে। যে করেই হোক লন্ডন তো যেতে হবে। ১৯ তারিখে সৌদি থেকে ঢাকায়। ২১ তারিখ ভোররাতে ফ্লাইট।যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা নেই। টিভি তে দেখি একের পর এক ফ্লাইট বন্ধ। 

আমি কিন্তু হতাশ বা নিরাশা কখনো হইনা। আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা নিতেই এয়ারপোর্টে এলাম। ঐ যে বললাম কারফিউ। কারফিউ এর মধ্যেই এয়ারপোর্টে যেতে হবে কোন গাড়ি নেই। যাতায়াতের কোন ব‍্যাবস্থা নাই। মেইন রোড কিছু রিক্সা আছে। ভাগ‍্য ভালো য়ে এয়ারপোর্টের সেই নাম্বারে দিনের শুরুতেই ফোন দিলাম ভাই আপনার সাহায্যের দরকার অপর প্রান্ত থেকে বললেন কি করতে হবে বলেন আমি বললাম এখন তো কারফিউ চলছে কিন্তু আপনি আমাকে একটি গাড়ি পাঠাতে হবে? তিনি বললেন কোথায়? আমি বললাম নিকুন্জ-২ তখন বললেন আপনি রেডি থাকবেন গাড়ি চলে আসবে। রাতে রেডি হয়ে ফোন দিলাম গাড়ি আসলো আমরা এয়ারপোর্টে এলাম। 

বিদায় নিলাম শালা সহ বাসার সবার নিকট থেকে তবে পূর্ণাঙ্গ বিদায় না আবার যদি ফিরে আসতে হয়। সেই আতংক তো রয়েছে।

কি হবে আমরা কেউ জানি না? তবে ভাগ‍্য ভালো আমাদের ফ্লাইট পরিবর্তন হয় নাই। বিমানবন্দরে থমথমে ভাব কি হবে কেউ জানে না আগের দুইদনের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।বিমানযাত্রীরা এদিক সেদিক ছুটে চলেছে কেউ তাদের সঠিক উত্তর দিতে পারছে না কারন তখনো বাংলাদেশের সব খানে ইন্টারনেট নেই।

আমরা কোনরকম মালামাল বুকিং দিয়ে বর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মজিব কর্নার দেখলাম। সেই মজিব কর্নার আর নেই। মজিবুর রহমানের সব মূর্তি ভেংগে ফেলা হচ্ছে। তার পাশেই পর্যটনের শো রুম। এরই পাশে স্নাক্সের দোকান সেখান থেকে দুইজন দুইটি ছোট্ট মাটির কাপের দৈ খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেলাম। ক্লান্তি এবং দূঃশ্চিন্তা মিনিশেই উড়ে গেলো। এরপর ১০নং গেইটে আমাদের ফ্লাইট অপেক্ষাকৃত। ফ্লাইট উঠে সেই যে শান্তি। চলে এলাম একটি বাংলাদেশের ক্লান্তি কাল থেকে।প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের এখনো মনের গহীনে আছে এবং রবে চিরকাল।

বিকেল ৩টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর পৌঁছলাম। বাসায় ফোন দিয়ে সবাইকে জানালাম।এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় একটি ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করলাম । এলিজাবেথ লাইনে হিথ্রো থেকে সোজা হুয়াটচ‍্যাপেল স্টেশনে। বড় মেয়ের জামাই সাফায়েত হোসেন আমাদের জন‍্য হুয়াইটচ‍্যালে স্টেশনে অপেক্ষা করছে। তার গাড়িতে করে বাসায় এলাম সে এক অন্য রকম শান্তি।

অফিসের হুয়াটস গুরুপে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালাম।সাথে সাথেই মেহেদী ভাই বললেন আলহামদুলিল্লাহ। কাল থেকে কি কি কাজে যোগ দিতে পারবেন?  আমি বললাম ইনশাআল্লাহ। সেই থেকে কাজ শুরু চলছে তবে মেহেদী ভাই আর আমাদের সাথে কাজে নেই। তিনি চ‍্যানেল এস থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন দায়িত্বে আছেন মিল্টন রহমান ভাই। আমি এখনো কাজ করে যাচ্ছি।

জুলাই মাসের শেষের দিকে লন্ডন সহ বৃটেনের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বেশ গরম বা জমজমাট। প্রতিদিনই কোন না কোন স্থানে চলছে প্রতিবাদ সমাবেশ। আলতাব আলী পার্ক যেনো মুখরিত ছিলো শ্লোগানে শ্লোগানে।

৫ই আগস্ট ২০২৪ ইস্ট লন্ডনে আলতাব আলি পার্ক জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো। হাজার হাজার মানুষের সমাগম। ধর্ম বর্ণ নারী পুরুষ। সব বয়সের মানুষের সরব উপস্থিতি। যা কখনো পূরবে হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে কিনা জানিনা । সেই দৃশ্য ভুলার নয়। মানুষের মধ‍্যে যে বিজয়ের উল্লাস তা কখনো পরিমাপ করার মতো নয়।৫ই আগস্ট এবং ৬ই আগস্ট দুইদিন ব্যাপী চলে আনন্দ উৎসব। একদিকে শহীদ মিনারের সামনে আলোচনা শ্লোগান আর অপর পাশে শিল্পীদের গান। বাংলাদেশের পতাকায় পতাকায় ছেয়েছিলো পুরো এলাকা।

অবশ‍্য আমার দুইজন সহকর্মী সাংবাদিক ছাত্র জনতার হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন। তখন এক থমথমে পরিবেশে কে কার বিচার করবে। খবর আসতে শুরু করলো সাংবাদিক পেলেই নাজেহাল করছে ছাত্রজনতা। সকালে আমি চ‍্যানেল এস এর চ‍্যারিটি পাটনার ইসলামীক রিলিফ এর একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বিকালে আলতাব আলি পার্কে আসি তখন মানুষ আর মানুষ। আমাকে অধিকাংশ মানুষ চিনেন। তারপরও গেইট থেকে ক‍্যামেরা বের করে কাঁধের পিছনে ব‍্যাগ ঝুলিয়ে এক হাত উঁচু করে অপর হাত দিয়ে বলে বলে একটি সাইড দেন। অতি কস্ট করে মানুষ ঠেলে ঠেলে শহীদ মিনারের সামনে যেয়ে ছবি তুলে এলাম কিছুটা ভয় ছিলো এই বুঝি কেউ আক্রমণ করে? কিন্তু আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা হয় নাই।

রাতের নিউজ দেখে অনেকেই বলছেন সুন্দর নিউজ হয়েছে। আমি সবসময় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকি। কোন দল? কে বা কারা আমার সেইটা বিষয় না। আমি সঠিকভাবে নিউজ তুলে ধরার চেস্টা সবসময় করে থাকি।

ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। তবে প্রত‍্যাশা পূরনে কতটুকু সফল হচ্ছে সেইটা সময় বলে দিবে।

এরই মধ‍্যে আয়নাঘরের অনেক লমহর্ষকর বর্ননা ফুটে উঠেছে । শেখ হাসিনার পলায়ন এবং ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সকল মন্ত্রী ছিলেন অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আবার অনেকে ধরা পড়েছেন।

যারা ধরা পড়েছেন তাদের সেই দৃশ্য আমরা দেখেছি। সাবেক বিচারপতি মানিক কলা পাতায় শুয়ে থাকার দৃশ্য কিম্বা দরবেশ বাবা নামে পরিচিত সালমান এফ রহমান ও আনিসুল নৌকায় কপে লুংগি পড়ার দৃশ্য। কি অদ্ভুত এই দুনিয়া সকালে বাদশাহ বিকেলে ফকির।এখনো অনেক ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। ক্ষমতাধর অনেক নেতাই নতজানু হয়ে তাদের অপরাধের ফিরিস্তি দিচ্ছেন।

শেখ হাসিনা ভারত থেকে মাঝেমধ্যেই অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আওয়ামীলীগকেও নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চললেও আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। নতুন সাধারণ সম্পাদক নিয়োগ নিয়ে চলছে জল্পনা কল্পনা।

গঠিত হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন। এ নিয়েও আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। তারপরও বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার। ভোটের অধিকার ফিরে আসবে এমটাই প্রত্যাশা। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন সম্ভব নয়। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একইসঙ্গে চলবে। এমনকি বলছেন প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই চলছে নানা আলোচনা আর সমালোচনা। সংবিধান মানা না মানা চলছে তর্ক বিতর্ক । রাস্ট্রপতি অপসারণের জন‍্য আন্দোলন কম হয়নি এখনো হচ্ছে।

আওয়ামীলীগের আমলে যে সকল আসামী গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের একের পর এক খালাস দেওয়া হচ্ছে।কোন দিকে যাচ্ছে দেশের বিচার ব্যবস্থা সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে? আবার আওয়ামীলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে চলছে একের পর এক মামলা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আমাদের রাজনীতিতে ধংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি আমার শাশুড়ি লন্ডনে এসেছেন তার শরীর চেকআপ সহ সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে ইতিমধ্যেই দুইটি চোখ অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে । তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

তবে ডিসেম্বরের বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। বিজয় দিবস পালন নেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বরংচ মুক্তিযুদ্ধাকে জুতার মালা পড়িয়ে অপমান করা হচ্ছে। কিন্তু জাতির বিবেক আজ নিশ্চুপ নিরব।

জাহাজ ৭ জন খুন। নেই কোন বিচার? র‍্যাব এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ঘুমের ওষুধ সেবন করিয়ে একের পর হত্যা করেছে। তাদের ভাষ‍্য শুনলে মনে হয় মানুষ খুন কোন ব‍্যাপারই না।

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য আমাকে মর্মাহত করেছে।

পাঠ‍্য পুস্তকে ইতিহাসের বিকৃতি। স্থান পেয়েছে বিভিন্ন বকাঝকা। কি শিখবে নতুন প্রজন্ম? 

২৫শে ডিসেম্বর ঢাকার সচিবালয়ের ৭নম্বর বিভাগের আগুন পুড়েগেছে সকল নথি পত্র। আগুন লাগার কারণ এখনো অজানা । মারা গেলেন এক ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বক্তব্য শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা।

ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবস এবং বিজয়ের অনেকগুলো অনুষ্ঠান পালন করছে দেশে বিদেশে । চ‍্যানেল এস এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছিলো বিশাল অনুষ্ঠান। লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের বিজয় দিবস বিশেষ আয়োজন।এছাড়া প্রতিদিন কোন না কোন বিজয়ের অনুষ্ঠান তো ছিলোই।

ছিলো বিয়ের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান অংশগ্রহণ না করে উপায় ছিলো না। ২৯শে ডিসেম্বর একই দিনে দুপুরে বিশিষ্ট ব‍্যাবসায়ী ও সমাজসেবক আক্কা হোসেনের ছেলে রাজিব হোসেন ছেলের বিয়ে মে ফয়ার ভেনুতে এবং রাতে ছিলো কমিউনিটির বিশিষ্ট সমাজসেবক ও সংগঠক গ্লোবাল জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মহিবুর রহমান মহিব ভাইয়ের ছেলে আহমেদ লাবিব রহমানের বিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ । মাঝে চ‍্যারিটি ইভেন্ট নিউজ কভার করা।

৩০শে ডিসেম্বর দুপুরে প্রবাসী অধিকার পরিষদের নো ভিসা ফি মৌকুফ করার দাবীতে প্রেস কনফারেন্স লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের অফিসে যার পুরো দায়িত্ব ছিলো আমার উপর। কেননা প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি বর্তমানে বাংলাদেশে আছেন। এ‍্যাসিস্টেনেট সেক্রেটারি হিসেবে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছ। রাতে ছিলো বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদের বিশাল আয়োজন রয়েল রেজেন্সি হলে। অনুষ্ঠান শেষে রাত প্রায় ১২টায় ঘরে ফেরা।

৩১শে ডিসেম্বর সকাল বেলাই আমার স্ত্রী বললেন আজ সকাল ৯.০০ জব সেন্টারে ইন্টারভিউ! কি আক করা চলো। এক সংগে গেলাম। ১০ মিনিট আগেই যে পৌছলাম হুয়াইটচ‍্যাপেল জব সেন্টার কবি নজরুল ইসলাম স্কুল সাথে এবং লন্ডন এন্টারপ্রাইজ একাডেমির পাশের রোড। ভাগ্য ভালো জব সেন্টারের সামনেই কার পার্কিং পেলাম। এই ইন্টারভিউ হলো কাজ খোঁজার ফিরিস্তি দেওয়া। বেনিফিট থেকে ইউনিভার্সেল ক্রেডিটে গেলে প্রথম কয়েক মাস যে কাজ না করেন তাকে প্রতি সপ্তাহে কি কি কাজ খুঁজছেন তার ফিরিস্তি দিতে হয়। আমার একটি ইন্টারভিউ ছিলো শুধু হাজিরা দেওয়া কেননা আমার দীর্ঘ দিন ধরেই একই কাজ করি। সব ঠিক আথে কিনা জানলেন এবং বাসার কন্টাক্ট সহ তিনটি বিল আপডেট করতে বললেন ব‍্যাস। কিন্তু আমার স্ত্রী প্রতি সপ্তাহে হাজিরা দিতে হচ্ছে। 

দুপুরে শুরু হলো চ‍্যানেল এস এর নিউজ। সহকর্মী চ‍্যানেল এস এর নিউজ এডিটর এ‍্যান্ড রিপোর্টার শরিফল ইসলাম চৌধুরী সাথে বেশ কিছু ইন্টারভিউ করে অফিসে যেয়ে কার্ড জমা দিয়ে অন‍্য সহকর্মীদের সাথে কথা হলো হেড অফ নিউজ মিল্টন রহমানের সাথে আগামী কালকের আমার রিপোর্ট নিয়ে। নববর্ষের শুভেচ্ছা ও আগামী প্রত‍্যাশা।

শরীফ ভাইকে বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের মিটিং নিউজ কভার করে। বিয়ের দাওয়াতে যাই আমার প্রিয মানুষ এখলাছুর রহমানের ভাই জাহেদুর রহমানের শুভ বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। এর মধ্যে দিয়ে এই বছরের বিদায় দেওয়া হচ্ছে।

 চীনের তিব্বতে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থলের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে চীন।এই বাঁধ নির্মাণ করা হবে ইয়ারলুং জ্যাংবো নদীর উপর। নতুন বাঁধটি নির্মাণে থ্রি জর্জেস বাঁধের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ব্যয়ের মধ্যে প্রায় পনেরো লাখ মানুষকে অন্যত্র পুনর্বাসনের খরচও রয়েছে। থ্রি জর্জেস বাঁধ নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩৪.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।তবে তিব্বত মালভূমির পূর্বাংশে এই প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।এই আশঙ্কা নিয়েই বছর শেষ হচ্ছে।

 মজিবুর রহমানের সব মূর্তি ভেংগে ফেলেছে। আজ সকালে দেখলাম শেখ মজিবুর রহমান সহ জাতীয় চার নেতার মূরালটি ও ভেংগে ফেলা হচ্ছে। 

ছাত্রদের সমাবেশ চলছে শহীদ মিনারে। পূর্বের কর্মসূচি গুলি বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের। অনেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।

সঠিক ইতিহাস লেখতে ঘরিমসি। যে সরকার ক্ষমতায় আসে তার ইচ্ছামত ইতিহাস লেখে। সব কৃতিত্ব অর্জন তার আর বাকি কেউ নেই ছিলো না। সঠিক ইতিহাসের পতায় সবাইকে মূল্যায়ন করতে হবে না হলে জনসাধারণ ও নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তিতে পড়বে।  সঠিকভাবে ইতিহাস লেখা জন‍্য আকূল আবেদন জানাই । সবাইকে ধন্যবাদ। নতুন বছর নিয়ে আসুক সবার জন্য অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি । বিদায় ২০২৪।


Similar Posts