পদ্মা সেতু ঘুরে দেখার আনন্দই আলাদা।
মোঃ রেজাউল করিম মৃধা।
ঘুরে এলাম বাংলাদেশের সর্ববৃহত সেতু। যার নাম পদ্মা বহুমূখী সেতু। এই সেতু নির্মানের অনেক ইতিহাসই আমাদের জানা। সেই দিকে যাচ্ছি না আমি শুধু আমার দেখার অনুভূতি বলার চেস্টা করছি।
২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে সেতু বিভাগ। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৬.১৫ কি. মি দৈর্য্যের বাংলাদেশের দীর্ঘতম “পদ্মা বহুমুখী সেতু” বাংলাদেশের সর্ববৃহত এবং বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় ১২২ তম অবস্থানে রয়েছে।
দুই বছর পূর্বেও বাংলাদেশে সস্ত্রীক এসেছিলাম। এবার এসেছি একা। তখন যাওয়ার জন্য অনেক প্লান করেও শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় নাই। আসলে বেশী বড় প্লান বাস্তবায়ন সমস্যা হয়ে উঠে।এবার প্লান ছোট শুধু যেতে হবে এই আর কি? যাওয়া প্রবল ইচ্ছা কিন্তু সময় করা কঠিন হয়ে পরেছিলো। তারপরও গত শনিবার সব কিছুকে উপেক্ষা করে বেশ সাহস নিয়ে সকাল ১১ টার দিকে রওয়ানা দেই।
অবশ্য যেয়ে আবার চলে আসতে হবে কেননা একেতো পরের দিন থেকে টানা দুইদিন বিএনপির ডাকা অবরোধ এবং শনিবার রাত ৯টায় “মৃধা শো” শত কস্ট কিম্বা প্রতিকূলতার পরও চলছে দীর্ঘ ৩ বছরের বেশী সময় ধরে “মৃধা শো”চালিয়ে যাচ্ছি।
আগের দিন পরিকল্পনা করলে হয়তো আরে সকালে যাওয়া যেতো কিন্তু নাস্তার টেবিলে দ্রুত সিদ্ধান্ত। ছোট শালা ঝিল্লুর রহমান পরাগ বললো
দুলাভাই শরীরের কি অবস্থা?
যদিও কয়েক দিন ধরেই শরীর ভালো যাচ্ছিলে না।
বাহিরে গেলেই প্রচন্ডে ঘেমে যাই বাসায় এসে গোসল করা সহ সব কিছু না ধূইয়ে ব্যাবহার করার কোন উপায় থাকে না। একবারের বেশী কোন কাপড় পরা সম্ভব নয়। আবহাওয়া পরিবর্তনের কারনে ঠান্ডা লেগেই আছে। রাত হলে ঠান্ডার পরিমান বেড়ে যায়। আবার সকালে নির্দিষ্ট কাজে বের হতে হয়। তা না হলে কাজ যে শেষ হবে না। অবরোধে পরলে যাতায়াতের সমস্যার শেষ নেই। বাসে উঠা সব চেয়ে বেশী ঝুঁকি। তাই প্রবাস থেকে আমরা যারা বাংলাদেশে আসি তাদের কোন কর্ম অসুখ হতে নেই। নেই কোন অজুহাত ও। গাঁথার মতো চলতেই হবে। হাতে গুনা দিনগুলি দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কাজ শেষ না করতে পারলেও কিছু কিছু কাজ অন্তত শুরু করতে হবে। বাকীটা হয়তো কাউকে দায়িত্ব দিলে শেষ করবেন তবে কোন অজুহাত দিয়ে যদি বসে থাকেন তবে আপনার সফরটাই মাটি হয়ে যাবে।
আমার পরিবারের সবাই লন্ডনে। দেশের বাসাবাড়ি সহ জমিজমার কিছু কাজতো সবার থাকে। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। জমিজমা মার্কেটে দোকান সহ ভোটার আইডি কার্ড করা। কিছু কাজ আছে যা নিজেকেই করতে হবে সেই কাজ গুলি প্রায়ই শেষ কিন্তু অবরোধের কারনে শরীরের দিকে গুরুত্ব দেওয়ার সময় নেই। কাজ করতেই হবে না হলে আবার কখন আসবো তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
আমি বললাম অনেক ভালো!
তাড়াতাড়ি তৈরী হও। সাথে পরাগের স্ত্রী অনন্যা এবং একমাত্র মেয়ে জারা।
আমি আসার পর থেকেই জারা বলছে ফুপা ফুপা আমরা কবে পদ্মা সেতু দেখতে যাবো?
আমি অবশ্য ওকে আস্বস্থ্য করে ছিলাম যাব একদিন। তাই শরীর কে গুরুত্ব না দিয়ে বিশেষ করে জারাকে দেওয়ার কথা রক্ষা করাও আমার একটি বড় দায়িত্ব হয়ে গেছে না হলে ছোট মানুষটি মনে কস্ট পাবে। হয়তো মেনে নিতো কিন্তু নিজেকে অপরাধী মনে হতো।
গতবারও অনেক প্লান করে যাওয়া হয় নাই। তাই নাস্তার টেবিলে নাস্তা শেষ সবাই তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে বাসার সামনে থেকেই সিএনজি নিয়ে সোঁজা সাইদাবাদ সেখান থেকে ইলিশ পরিবহনে এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে মাওয়া পৌছে গেলাম। বাড্ডা থেকে সাইদাবাদ যেতেই যত সময় । টার্ফিক কাকে বলে গাড়ির চাকা যেনো ঘুরে না। ঘন্টা দুয়েকের বেশী সময় শুধু বাড্ডা থেকে সাইদাবাদ যেতে।এতো ট্রাফিকের একটি কারনও ছিলো মকিঝিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রো রেল উদ্বোধন করেছেন এজন্য অন্য সব রোড বন্ধ। সেই ট্রাফিক মনে হয় বিশ্বের সেরা ট্রাফিক জ্যাম।
তবে সাইদাবাদ থেকে মাওয়া যেতে খুবই আরাম এবং মনোরম পরিবেশ এবং রাস্তাও মশ্রিন। ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিজ ও আছে এই রাস্তায় দুই দিকে গ্রামীন পরিবেশ সবাইকে আকৃস্ট করে।
এই সুন্দর অত্যাধুনিক রাস্তাটিই পদ্মা সেতুর সাথে সংযোগ হয়েছে।পদ্মা ব্রিজের চেক পোস্টের ঠিক কিছুটা পূর্বেই এই বাস বাম দিক দিয়ে নিচে নেমে এলো এবং আঁকাবাঁকা মনোরম মেঠো পথ দিয়ে জয় বাংলা চত্তরে বাস এসে থামলো। এই জয় বাংলা চত্তরটি টুরিস্টদের জন্য এক আকর্শনীয় এখানে স্থান পেয়েছে বংগবন্ধু ভাস্কর্য । এর পাশেই রয়েছে ইলিশ মাছে আকৃতি দিয়ে চমৎকার ইলিশ টাওয়ার।
বাস থেকে এই চত্তরে নামার সাথে সাথে পাবেন টেম্পু, অটো রিক্সা সহ ছোট যানবাহন। এদের ব্যাবহারও অত্যান্ত ভালো যদিও পয়সা যার কাছ থেকে যা পারছে নিচ্ছে। পদ্মার নদীর পারে যাওয়ার পূর্বেই প্রথম দিকের পিলার গুলি ঘুরে ঘুরে দেখাবে। এরপর নিয়ে যাবে নদীর পারে। অবশ্য ইলিশ টাওয়ারের পাশে দিয়েই সুন্দর রাস্তাটি নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গেছে এবং নদীর পারে বিশাল একটি কার পার্ক রয়েছে। এবং এই রাস্তার দুই পাশ দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নামের বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট। অবশ্য নদীর ঘাটে টং দিয়ে এক সাথে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
এই রেস্টুরেন্ট গুলিতে তাজা ইলিশ ভাজা ও ভাত খাওয়ার একটি অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে।অবশ্য অন্যান্য মাছ সহ মুরগী এবং গরুর মাংশ পাবেন আর মজাদার ডাল পাবেন ফ্রি। তাজা ইলিশ ভাঁজা খাওয়ার চেয়ে ছবি তোলার সাঁধ ই বেশী। তাই এখানে এসে ছবি তুলেন না এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে।
আমাদের নদীর ঘাটে নামিয়ে দিয়ে অটো চলে গেলো। ঘাটে নামতেই ট্রলার থেকে ডাকাডাকি শুরু হলো। আসুন আসুন আমরা এখনি ছেড়ে যাবো কিন্তু আসলে লোক ভর্তি না হলে ছাড়ে না। তবে যাত্রীদের ভাড়া নির্দিষ্ট করা। জনপ্রিয় মাত্র ১০০ টাকা। অবশ্য আপনি রিজার্ভ নিতে পারবেন সেক্ষেত্রে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হবে। যারা ভয় পান তারা হয়তো রিজার্ভ না করে সবার সাথে এক সাথে গেলে সাহস পান। আবার কেউ কেউ নদীতে যেতেই ভয় পান অনেকে আবার সাঁতার না জানার কারনে নদীর কিনারায় বসে দূর থেকে পদ্মা ব্রিজ দেখেন। ভয়ের কারন নেই বললেই চলে রয়েছে লাইফ জ্যাকেট।
আমরা ট্রলারে উঠে বসলাম। ট্রলারে বসার জন্য ১০ থেকে ১৫টি চেয়ার বসানো আছে। চেয়ারের প্রথম সারিতে বসে পদ্মা নদী এবং ব্রিজ দেখা পদ্মার মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘুরে আসা। পদ্মা সেতুতে মোট ৪২টি পিলার রয়েছে। আমাদের ট্রলার ১২ এবং ১৩ নং পিলারের মাঝ দিয়ে ডুকে ১৮ ও ১৯ পিলারের মাঝ দিয়ে আবার ঘুরে ট্রলার ঘাটে ঘুরে আসা। যখন পিলারের নিচ দিয়ে পদ্মা নদীর মাঝ দিয়ে ট্রলার ঘুরছে তখন শুধু আমি নই কেই আর চেয়ারে নেই সবাই দাড়িয়ে ছবি তুলছেন কেউ কেউ লাইফ দিচ্ছেন। প্রতি পিলার যেনো আমাদের আত্বমর্যার আমাদের অহংকার ।এই ঘুরে আসতে সময় লাগে ঘন্টা খানেক। তবে এই ঘুরে আসার মাঝে আনন্দই আলাদা। একে তো শীতল উন্মুক্ত হাওয়া এবং স্তম্ভ আমাদের আত্ব পরিচয়।
যদিও দূর থেকে দেখা যায় ব্রিজ মাঝখানে নদীর পানির সাথে মিশে গেছে কিন্তু না যখন আপনি নদীর মাঝখানের পিলারের উপরের দিকে তাঁকালে দেখবেন অনেক উঁচু। বড় বড় স্টিমার অনায়াসে যেতে আসতে পারে। এখন নদীতে স্রোত অনেকটাই কম। বর্ষা মৌসুমে কিছুটা ঝুঁকি থাকতেই পারে।
এই পদ্মা সেতু বাংলাদেশের বড় অর্জন প্রতি পিলার মাথা উঁচু করেছে বাংলাদেশকে। যোগাযোগে এনেছে আমুল পরিবর্তন। যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি ফেরি ঘাটে দিনের পর দীর্ঘ অপেক্ষা আজ সেখানে মাত্র কয়েক ঘন্টায় যাতায়াত এক অবিশ্বাস্য।
এই পদ্মা সেতু দেখার জন্য মাওয়া ঘাট এখন পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা শুধু যে বাংলাদেশীরা আসেন এমন নয় এখানে সব দেশের পর্যটকরা আসেন। মাওয়া ঘাট এবং এই পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এলাকার হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। জমির দাম বেড়েছে বহুগুন এলাকাবাসী ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেছে। নতুন নতুনপ্রজেক্ট এলাকা চেহারা পাল্টে দিয়েছে। অত্যাধুনিক, মসজিদ, হাসপাতাল, শপিংমল সহ নিত্যনতুন অট্টালিকার নির্মান কাজ চলছে। এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।