আমার স্বচক্ষে দেখা ১৯৭১ ও ২০২৪।
আমার স্বচক্ষে দেখা ১৯৭১ ও ২০২৪, আমি দুইটি আন্দোলনের রাজ স্বাক্ষী
মোঃ রেজাউল করিম মৃধা
আমার মতো সুভাগ্যবান মানুষ কমই আছেন। কেননা আমি দুইটি যুদ্ধ বা সংগ্রাম ও আন্দোলন স্বশরীরে উপস্থিত থেকে নিজ চোখে দেখেছি।
কেউ কেউ অবশ্য বলেন দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধ আমি এখানে একটু দ্বিমত পোষণ করি।কেননা ১৯৭১ এবং ২০২৪ ভিন্ন দুটি প্রেক্ষাপট । যুক্তি দিয়ে ইতিহাস হয় না ইতিহাস সৃষ্টি করে।ভুলে গেলে চলবে না । ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাথে যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জ্বতের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের লাল সবুজের পতাকা এবং আমাদের নিজস্ব মানচিত্র এক খন্ড বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর এ অর্জন একদিনে সম্ভব হয়নি। এর জন্য বাঙালি জাতির ছিল সুদীর্ঘ তপস্যা ,সাধনা,চেস্টা ,ঐক্যবন্ধ সংগ্রাম এবং ২৫শে মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর আমরা পাকিস্তানীদেরকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করি।
আর ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট যদিও অনেকে ৫ই আগস্ট বলতে রাজি হয় ৩৬ জুলাই।কি হাস্যকর তাই না? অবশ্যই তাই। কেন ৩৬শে জুলাই? সেই ঘটনাও আপনাদের জানা। ভাসুরের নাম মুখে আনা মানা! ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও হ্যা এই শোক দিবস এখন আর শোক দিবস নেই। কি অদ্ভুত আমাদের দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান । জাতির পিতা বললে হয়তো আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হতে পারে? কিন্তু কি করবো এই সত্য বাদ দিয়ে তো স্মৃতি লেখা যাবে কি?
স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। আমি সবসময় বলি যার যে অবদান তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি উসমানী, আবদুল হামিদ খান ভাষানী,জাতীয় চার নেতা, হোসেন শহীদ সরোয়ারদী, একে ফজলুল হক সহ ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান, অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়েছেন এবং ৫ই আগস্ট যারা জীবন দিয়েছেন সকল শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।তাদের অবদান চিরস্মরণীয় করে রাখতে হবে ।
যে কথা বলিছিলাম।১৯৭১ এবং ২০২৪।
আমি তখন খুবই ছোট,৬/৭ বছর বয়স হবে আমার। তার পর ও অনেক কিছু মনে পরে আজ। স্মৃতিতে ফিরে যেতে চাই ।তখন সবে মাত্র পাঠশালায় যাই আর আসি। আমরা ছয় ভাইবোন, আনি সংসারে ৫ নাম্বার সন্তান আমার বড় দুই ভাই আর বড় দুই বোন আর আমার ছোট্ট আদরের বোনের জন্ম স্বাধীনতার পর। আমি ছিলাম সবার আদরের ছিলাম । শুধু ছিলাম না এখন আছি। শুধু ভাইবোন নয় আত্বীয় স্বজন এবং প্রতিবেশী সবাই আমাকে অনেক আদর করেন।আমার পিটাপিটি দুইবোন অর্থাৎ বড় ভাই, মেঝ ভাই, বড় বুজি, মেঝ বুজি।বড় ভাইকে আমরা সবাই মিয়া ভাই বলে ডাকি। দুই বোনের সাথেই পাঠশালায় যেতাম।
স্কুলে যাচ্ছি আর আসছি হঠাৎ শুনলাম দেশে গন্ডগোল লেগে গেছে তাই থমথমে ভাব বিরাজ করছে। স্কুল, পাঠশালা তখন ও চলছে তবে তেমন প্রাণ চন্চলতা নেই।ভয়ভয় একটি ভাব। গোন্ডগোল তখনো ও ঢাকা কেন্দ্রীক । এলাকায় তখন ও যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে নাই।
এদিকে মিয়া ভাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অর্থাৎ আর্মিতে আছে পাকিস্তানের লাহোরের সেনানীবাসে । বাবা মা দুশ্চিন্তায় । তাদের খাওয়া দাওয়া নাই শুধু বড় ভাই এর নাম যিনি সাধারন সৈনিক থেকে কর্ম দক্ষতায় আজ অনারেবল ক্যাপ্টেন হয়েছেন। স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী নিজ হাতে তাকে সম্মাননা দিয়েছেন।মিয়া ভাইর কোন খোঁজ খবর নাই বাড়ীতে অনেকটা হতাশা ভাব বাবা মা মিয়া ভাইর খোঁজ নেওয়ার চেস্টা করেন ঢাকা থেকে কেউ গ্রামে আসলে বাবা ছুটে চলে যেতেন তার কাছে। মিয়ার কোন খবর পাওয়া যায়কিনা ?
হঠাৎ করে একদিন মিয়া ভাই বাড়ীতে চলে এলেম। সেদিনের স্মৃতি কোনদিন ও ভুলতে পারবো না। মুক্তিযাদ্ধের বেশ কয়েকদিন পরেই হবে। মিয়া ভাই বাড়ীতে এসেছে এখবর এলাকার মধ্যে এক আলোড়ন সৃস্টি করে ফেললো। শত শত লোক আমাদের বাড়ীতে ভিড করতে লাগলো এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার লোকজন ও ছুটে এসে দেখা করতেএবং মিয়া ভাইর কথা শুনতে।আগেই বলেছি আমাদের বড় ভাইকে মিয়া ভাই বলে ডাকি। মিয়া ভাইর নাম মোহাম্মদ ইরফান আলি মৃধা। সহজে ইরফান মৃধা বলে। বাবা মা অনেক খুসি শুধু বাবা মা নয় আমরা ভাইবোন সবাই অনেক অনেক খুসি । মিয়া ভাই বাড়ীতে এসেছেন আমরা সবাই খুঁসি হলেও পাঠশালার মাস্টার আ: করিম মোল্লা খুঁশি হতে পারেন নি। কারন তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সদস্য। তিনি বলতেন” বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হবেনা।পাকিস্তান ই ভালো”। আমাদের বাড়ীতে এতো লোকের আসা যাওয়া সে কিছুই সহ্য করতে পারছে না। এলাকার সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর মাত্র এই একটি পরিবার বিপক্ষে। পাকিস্তানের দালাল হিসেবে পাক হানাদার দের সাথে কাজ করতো।মুক্তি বাহিনিদের খোঁজ খবর পাকিস্তানীদের কাছে দিতেন।হিন্দুদের বাড়ী চিনিয়ে দিতেন।এমনকি লুটতরাজ ও করতেন।
এলাকায় করিম মাস্টার বলতে শুরু করলো “ এত দিন আমরা ভালোই ছিলাম, এখন ইরফান দেশে এসেছে এ খবর পাকিস্তানিরা জানতে পারলে আমাদের ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে দিবে”।
মনে পরে তখন বর্ষাকাল, মাস দিন ঠিক মনে নেই। তবে বর্ষাকাল এটা ঠিক মনে আছে। রাজাকারের অত্যাচারে মিয়া ভাইকে ও অন্যত্র চলে যেতে হলো। ভাবী গেলেন তার বাবার বাড়ি।আর রাজাকার করিম মোল্লা শুধু বলতে থাকে ইরফানের জন্য আমাদের এলাকা পুড়িয়ে দিবে, লোকজন কে হত্যা করবে। এদিকে বাড়ীর পাশেই পদ্মার পাড়, লন্চ স্টিমার র যা যায় দেখা যায়।অনেক সময় লন্চে করে মিলিটারী যাওয়ার সময় গুলি করে।তখন আমরা শংকিত হই। বাড়ি থেকে বেশী কোথাও যাই না । সবাই ভয়ে আতংকিত। বেঁচে থাকাই বড় কথা আমাদের পাশের গ্রামই হঠাৎ করে একদিন মিলিটারী প্রবেশ করে বাড়ী ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হত্যা করে গনহারে। আর অনেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে গন্তব্য হীন পথে।
আমাদের বাড়ী এমনিতেই সবার টার্গেট। মিলিটারী আমাদের বাড়ী আসবে এতে কোন সন্দেহ নাই। তাছাড়া এলাকায় রেডিও তেমন ছিল না। আমাদের রেডিও তে খবর শোনার জন্য অনেক লোক ছুটে আসতো। হিন্দুদের সংখ্যাই বেশী হবে। রাতের খবর শুনার জন্য চুপ করে সবাই বসে থাকতো। বাচ্চা কেউ কেঁদে উঠলে মুখ চেপে ধরতো।আর একটি ভয় এই বুঝি মিলিটারী আসছে। এ খবর শোনার সাথে সাথে কান্না থেমে যেতো।
হায়রে ভয় , ভয়ে ভয়ে সবার জীবন হা হা কার। আজ ভয় থেকে দূরে বহু দূরে কিন্তু সেই দিনের সেই স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।
আমাদেরই নৌকা। মাঝি নেই । মাঝি কেউ থাকলেও কেউ যেতে চায় না অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। বড় চাচার মেয়ের জামাই আমাদের এক মাত্র বড় দুলা ভাই। কারন তখনো আমার আপন বোনের কারো বিয়ে হয় নাই।এ দুলা ভাই আমাদের ভীষন আদর করতো।বিশেষ করে আমাকে অনেক আদর করতেন।আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। নৌকায় সবাই উঠেছে। ছোট চাচীর ভাত তখনো রান্না শেষ হয় নাই। সেই ভাতের হাডি নিয়েই এলেন। মা দুই বোন ও ছোট কাকার ছেলে হারুন মৃধা কে সাথে করে নৌকায় উঠলেন। কিন্তু আমার মেঝ বোন নৌকায় উঠে আবার যেন কি আনার জন্য বাড়িতে গেছে। ওকে রেখেই তাড়াহুড়া করে নৌকা চালাতে শুরু করলেন দুলা ভাই। ওর ডাক কেউ শুনেনা । দুলা ভাই বললেন নৌকা পিছনে ফেরানো ভালো লক্ষন নয়। আমি চিৎকার করে বললাম সাঁতার দে , সাঁতার দে আমি ওঁকে রেখে যেতে চাই নাই আমিতো ছোট মানুষ তারপরও চিৎকার করে বললাম সাঁতার দে । আমরা ভাইবোন সবাই সাঁতার জানি মেঝ বোন সাহানারা অবশেষে সাঁতারকেটে আমাদের নৌকায় উঠলো । আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না?
আমরা আমাদের বাড়ি থেকে ৩/৪ মাইল দূরের আমাদের এক দূরের আত্মীয়ের বাড়িতে ছোট্ট একে বারে ছোট্ট ছোনের ঘরে আমি, মা আর দুই বোন। থাকতাম। বাড়ির বাইরে যাওয়াতো দূরের কথা ঘর থেকে বের হলেই দুই বোন আকড়ে ধরতেন। মা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন। আমি যেনো তাদের চোখের মনি।বড় দুই ভাই কোথায় আছে কেউ জানিনা। মার সাথে শুধুই আমরা। মাঝে মধ্যে আমার দুলাভাই বাড়ির খবর আনতেন। আসার সময় মা বেশ টাকা নিয়ে এসেছিল সেই টাকায় চলতে হয়েছে। সেই সব দৃশ্য কি কখনো ভলা যায়?
এদিকে এক দিন আমাদের বাড়ি টার্গেট করে মেলিটারির এক বিশাল বহর আসছে। খবর শুনে দাদী জায়নামাজ নিয়ে দুয়ারের মাঝে মোনাজাতে বসে গেছেন , বাবা ও আর একটি জায়নামাজ নিয়ে বসে গেলেন। আজ আর রক্ষা নেই। সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিবে। সোজাসুজি আমাদের বাড়ির দিকেই আসছে ছোট কাকা শুধুচেয়ে চেয়ে দেখছেন।আর ছটফট করছেন। হেঁটেহেঁটে একে বারে বাড়ীর কাছে এসেছে । এদের সাথে আছে রাজাকার করিম মোল্লা।বাড়ির কাছাকাছি ছোট কাকা কাঁদবেন না চিৎকার করবেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না।
কথায় আছে” রাখে আল্লাহ মারে কে” আল্লাহ সহায় থাকলেই কোন না কোন উপায় বের করেন। বাড়ির সামনে ছিলো পুকুর তখন পুকুর পাড়ে এসে সামনে যেতে একজন পানিতে পরে গেলে ভাগ্য ভালো যে মিলিটারী সাঁতার জানেনা । পুকুর দেখে আমাদের বাড়ি না এসে বাম দিক দিয়ে চলে গেলেন। করিম মোল্লা অনেক চেস্টা করেও ক্ষতি করতে পারলো না।
ছোট কাকা দেখতেছেন কলা গাছের ফাঁক দিয়ে যাতে গুলি ছুড়লেও গায়ে না লাগে। এই বুঝি গুলি ছুরবে কিন্তু না যখন দেখলো অন্য দিকে চলে যাচ্ছে তখন ছোটকাকা আনন্দে লাফিয়ে উঠে দাদীকে বলতে লাগলো “ মা মা মেলিটারী চলে গেছে”। তখন দাদী ও বাবা মোনাজাত শেষ করে। মিলিটারী চলে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন।
মিলিটারী পাশের গ্রামে যেয়ে আগুন দিতে দিতে চলে যাচ্ছে।আমরা এ সবের কিছুই জানিনা । বাবার মুখে পরে শুনেছি। লোক মুখে যখন শুনলাম ইব্রাহিম পুর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছ।মনে মনে ভাবলাম আমাদের বাড়ি আর নেই। বাবাকে হয়তো দেখতে পাবো না। তখন বর্ষার পানি নেমে গেছে। মাকে বললাম “মা এখানে থাকবো না চলে বাড়ি চলো “।এখনো ।ঠুসঠাস গুলির আওয়াজ কানে আসে। আগুনে ঘরবাডি পুরানো মানুষের চিৎকার শুনতে পাই।
কিছুদিন পর রেডিও তে খবর পেলাম মিলিটারীরা পরাজিত হয়ে আত্ব সমর্পন করেছে । বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম ।আনন্দে আমার দু চোখে অশ্রু এলো। দেশ স্বাধীন হয়েছে। সে কি আনন্দ। সেই থেকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।
২০২৪ সালের ১৯শে জুলাই পবিত্র হজ্জ্ব পালন বাংলাদেশের পৌছাম। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। এয়ারপোর্ট নামতেই বিভিন্ন খবর কানে ভেসে আসতে লাগলো। সৌদিতে প্রায় দেড় মাস ছিলাম। মক্কা, মদিনায় থাকা অবস্থায় দেশের তেমন খবর নেওয়া হয় নাই।ইবাদাত নিয়েই বেশী সময় পার করেছি। আমি আমার স্ত্রী দুইজনই একসাথে হজ্জ পালন শেষে দেশে ফিরেছি।
ইমিগ্রেশনে বিশাল লাইন। কোন নিয়ম নীতি নাই। হট্টগোল চলছে। হাজী সহ অন্যান্য যাত্রীরা বলাবলি শুরু করেছে দেশের অবস্থা এবং কে কিভাবে তার নিজের বাড়িতে যাবে। আমি ঢাকার বাড্ডায় ছিলাম। সেখানেই আমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র , কাপড় লন্ডনে যাওয়ার সবকিছুই ছিলো।
দীর্ঘ সময় পরে ইমিগ্রেশন করে লাগেজ নেওয়া লাইন বললাম না হযবরল অবস্থা। আমরা যারা হাজী তারা কিছুটা আল্লাহর নাম নিলেও অন্যদের যেনো ধর্য্যের বাঁধ ভেংগে যাচ্ছে। লাগেজ নেওয়া মাঝেমধ্যে কথা হচ্ছে কি করবো কোথায় যাবো। তখন এমন একটা আবস্থা ভাষায় বলে বুঝানো যাবে না। আতংকিত সবাই।সবার চোখে মুখে হতাশা ছাপ। কি এক বিব্রতকর পরিস্থিতি।
আল্লাহর প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস। আমি আমার স্ত্রী বললাম কোন চিন্তা করো না আল্লাহ ভরসা। আমার শালা অর্থাৎ স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের এয়ারপোর্ট থাকার কথা ছিলো। বাড্ডায় যাবো সব ঠিক থাকলেও ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের ফলে দেশের চরম অবস্থা। সারা দেশ জুড়ে কার্ফিউ দেওয়া। বাড্ডা সব চেয়ে খারাপ অবস্থা। বাড্ডা যাওয়ার কোন ভাবেই সম্ভব নয়। এখন কি করবো বাইরের কোন মানুষ কিম্বা গাড়ি এয়ারপোর্ট আসা সম্ভব নয়।
এক এক করে সবাই যার যার মতো করে চলে যাচ্ছে। এখন আমরা কি করবো? কোথায় যাবো? ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। অবশ্য এয়ারপোর্ট আশেপাশেই আমার নিজের বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি এমকি অনেক আত্মীয় ও আছে।সবার বাসায় কো যাওয়া সম্ভব নয়। যাওয়া যাবে না।
একেবারে এয়ারপোর্ট পাশে নিকুঞ্জ-২ আমার বড় শালার বাসা। সেই বাড়িতে যাবো সিদ্ধান্ত নিওয়া হলো। কি ভাবে যাবো? এয়ারপোর্ট থেকে বের হলে কি ঝামেলায় পরি কে যানে তাই এয়ারপোর্টে গেইট থেকে বের হওয়ার আগেই একটি রেন্টে কার অফিস আছে। সেখানে তাদের সাথে কথা হলো যা চায় দাম বা টাকা কোন ব্যাপারই না।আমাদের বাসায় যেতে হবে।
এয়ারপোর্টের গাড়ি ভাড়া করে বাসায় চলে যেতে যেতে দেখি রাস্তায় পুরাই ফাঁকা। ইন্টারনেট বন্ধ। শুধুমাত্র ফোন। আত্বীয় স্বজন সবাই ফোন যোগাযোগ। বাসায় যেয়ে ফোন ছাড়া খবর নেওয়ার কোন উপায় নেই। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ কি এক অদ্ভুত কান্ড। দীর্ঘ দিন পর সবাই টেলিভিশনে সামনে সংবাদের অপেক্ষায় কি ঘটছে এবং কি ঘটবে?
রাত দিন ২৪ ঘন্টা কারফিউ। পরদিন পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ কিন্তু আমাকে তো বাড্ডা যেতেই হবে। কেননা ব্রিটিশ পাসপোর্ট সহ কাগজপত্র আনতে হবে। খবর দেখছি আর ভাবছি কি করা যায়? দিনের সকাল ১০.০০ টা থেকে ১২.০০ টা পর্যন্ত মাত্র দুটো ঘন্টা বিরতি আবার কারফিউ।
এই দুই ঘন্টা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা। ফোনে ফোনে অনেকের সাথে কথা হয়েছে কিন্তু কেউ ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে না। মৃত্যুর ভয় । আর বাড্ডার বিশ্ব রোডেই সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক । রামপুরা থেকে উত্তরা পর্যন্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যালয় আর এই বিশ্ববিদ্যালয় সব আন্দোলন স্থান।
প্রতিটি মানুষ মৃত্যু ভয়ে অস্থির ।মৃত্যু ভয় আমার যে নেই তা নয়। তবে আমার বিশ্বাস। আল্লাহ আমাকে হেফাজত করবেন ।আমি একাই যাবো। আমার সাহস দেখে আমার স্ত্রী ও বললেন আমিও যাবো । তখন আমার শাশুড়ির চোখ কপালে উঠে গেছে। তিনি বললেন” তোর কি যাওয়ার দরকার রেজা গেলেই হবে”।
আমার দুই শালা এবং শশুর বাড়ির লোকজন কেউই এই আন্দোলনের, মিছিলে অংশ নেননি। তবে তাঁরা প্রচন্ড শেখ হাসিনা বিরোধী।বড় শালা মাহবুবুর রহমান প্রিন্স। বিএনপির পাগল। ছোট চাচা শশুর হাবিবুর রহমান হাবু বিএনপির বাড্ডা নেতা। কিন্তু সরাসরি মিছিল নেই। ঘরে বসেই যত বড় বড় কথা। ৫ই আগস্টের পর ফেইসবুকে তাদের গরম গরম স্ট্যাটাস দেখে নিজে মিলাতে পারি না। নিজের চোখে কি দেখলাম আর এখন কি লিখছেন। সে এক ইতিহাস।
সেই দুই ঘন্টা আমার এবং আমার স্ত্রীর বিশাল অভিজ্ঞতা। নিকুন্জ থেকে বাড্ডা। পাবলিক বাসে ২০টাকা ভাড়া। সিএনজি ২০০টাকা, উবার ৩০০টাকা হবে। কিন্তু সেই ২০শে জুলাই টাকা কোন সমস্যাই না। যেতে হবে এবং ফিরে আসতে হবে। সময় মাত্র দুই ঘন্টা।
বিসমিল্লাহি বলে বের হলাম। অজানা পথে চেনাজানা তারপরও আজ বেশ অপিরিচিত লাগছে। রাজধানী ব্যাস্ততম রাস্তা পুরো ফাঁকা। নিকুন্জ থেকে পায়ে হেঁটে ঢাকার নামকরা হোটেল “ঢাকার রেজেন্সি” হোটের মাঝ দিয়ে রাস্তা থাকলেও আজ পুরো মার্কেট বন্ধ তাই হোটেলের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে অভার ব্রিজ পাড় হয়ে খিলখেত এলাম কোন গাড়ি নেই।মোটর সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। এই সব মোটর সাইকেলে এমনি আমি উঠি না আর আজ তো মহা বিপদের দিন।
দুইএকটি রিকশা আছে যাত্রী ও কম নয় যে যার অবস্থানে যাবেন তাদের যে যেতেই হবে। আমাদেরও তাই। একটি রিকশা সবাই দাম করে। আমি বললাম বাড্ডা যাবেন। রিকশাচালক হেসে দিলেন,বললেন আপনি কি জানেন না ঐ রাস্তায় যাওয়া যায় না। যতটুকু যাওয়া যায় চলো। বলে ২০০ টাকা দিবেন। আজ টাকা কোন সমস্যা না। যেতেই হবে।মোটর চালিত রিক্সা। এয়ারপোর্টে রাস্তায় থেকে বিশ্ব রোড অর্থাৎ রামপুরা রাস্তা যেটাকে প্রগতি স্মরণি বলে।
কুড়িল বিশ্বরোড কিছুটা দূরে আসতেই রাস্তার অবস্থা নাজেহাল। বেরিকেড দিয়ে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তার মধ্যেই ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। অনেক ইচ্ছে করেই পথচারীদের গাঁয়ে বল লাগাচ্ছে। কারো কিছু বলার সাহস নেই। সুন্দরি কাউকে দেখলে সীস দিচ্ছে। যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ডিভাইডার বা আইলাইনার রাস্তা দিয়ে দিয়ে যাতে গাড়ি, রিকসা তো দূরের কথা মানুষ ও হাঁটতে না পারে। রাস্তার যেখানে বেরিকেড দেওয়া সেই খানে নেমে গেলাম। আবারও পায়ে হাঁটা শুরু।
পুরো রাস্তা জুড়ে ভাংচুরের দৃশ্য। বেরিকেড দিয়ে আটকানো। যমুনা ফিউচার পার্ক পার হয়ে কালাচাঁদ পুর যেয়ে আবার একটি রিকশায় কিছু দূর যেতে রাস্তা বন্ধ। আবার হাঁটা শুরু। এবার নতুন বাজার কাছাকাছি যেয়ে আবার রিকশা। একদিকে আমেরিকান দূতাবাস অপর দিকে ভাটারা থানা পুলিশ স্টেশন । ভয়ে ভয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে কখন থামায় কি জিজ্ঞেস করবে? সব যেনো আতঙ্ক। থানায় সামনে রাস্তা পুরোটা বন্ধ আর্মির টহলদার গাড়ি। রিকশাচালক রিকশা বারিধারার ভিতর দিয়ে থানার পিছন দিকের রাস্তা দিয়ে শাহাদাৎ পুর দিয়ে বাড্ডার দিকে যাচ্ছএ। বাড্ডা যাওয়ার প্রগতি সড়ক চলাচল বন্ধ।সুবাস্তর পিছন দিয়ে যেতে যেতেই ফাঁকা গুলির শব্দে কেঁপে উঠলাম সবাই। অনেকে তাড়াহুড়া করে ছুটাছুটি করছেন। গোলির মাঝখান থেকে কিশোর বয়সে ছেলেরা পুলিশ কে হুর্ররে দিচ্ছে। পুলিশ আবার দৌড়ে তাদের ধরার চেষ্টা করছে। উত্তর বাড্ডা বাজারের পিছনের রাস্তা দিয়ে যেতে আবারও কয়েকটা গুলির শব্দ। আমরা রিকশা নিয়ে একেবারে হোসেন মার্কেটের পিছনের রাস্তায় দাঁড়ালাম।
এর আগেই ফোনে ছোট শালা পরাগের সাথে কথা হচ্ছে। উত্তর বাড্ডা কুয়েতি মসজিদ আর হোসেন মার্কেট খুবই পরিচিত। নাম বললেই সবাই চিনে। আজ যেনো এক রনক্ষেত্র। রিকশা রেখে পায়ে হেঁটে বড় রাস্তা প্রগতি স্মরনী পাড় হতে সেই দৃশ্য কখনো ভুলার নয়। ভয়, আতঙ্ক, সংঘাত, উপর থেকে ফাঁকা গুলি আওয়াজ। ঠুসঠাস শব্দ।
এরমধ্যে পরাগ আমাদের দুইজনের পাসপোর্ট সহ অন্যান্য জিনিসপত্র তিনচারটি পলেথিন ব্যাগে করে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রয়োজন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন পাসপোর্ট।এই গুলি হাতে নিয়ে পরাগকে বিদায়ের দৃশ্য কখনো ভুলে থাকতে পারি না। কে বাঁচবে কে মরবে কেউ জানিনা।
বড় বোন ছোট ভাইয়ের মাথা এবং পিঠে হাত দিয়ে দোওয়া করে দিয়ে বললো সাধানে রাস্তা পাড় হয়ে সুজা বাসায় যা। সেই যে মায়া কোন কিছুর বিনিময় পাওয়া যায় না।পরাগ চলে যাচ্ছে এ যেনো পাজড়ের একটি হাড় ভেঙে যাচ্ছে। যদি বাসায় না পৌঁছায়? তাহলে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে আমাদের সহযোগিতা করতে এসে রাস্তায় পরাগের মৃত্যু। না আল্লাহর রহমতে পরাগ ঠিকমত বাসায় গিয়েছিলো।
আমরা সেই রিকশা আবার উঠলাম কেননা রিকশা বিদায় করলে যদি আর একটি রিকশা না পাই। রিকশার সংখ্যা খুবই কম। পরাগকে বিদায় দিয়ে আমরা যখন রিকশায় উঠি তখন রিকশাওয়ালা বলেছি” স্যার আপনি দেশ ছেড়ে ভাগতেছেন?”। সেই রিকশাওয়ালার উত্তর টা আজও দিতে পারিনি। “শুধু বললাম চলো”।
বাসায় না ফেরা পর্যন্ত একমুহূর্তও শান্তি পাই নাই। রিকশা, হাঁটা রিকশা, পুলিশের মহড়া, আর্মির প্লাটন প্লাটন গাড়ি কি ভায়াবহ পরিস্থিতি?
হাতে তিনটারটা পলিথিনের ব্যাগ। লোরে আর চোখে তাকালেই মনের মধ্যে আরো ভয় জমে উঠে। একটু জোড়ে হাঁটতেই আমার স্ত্রী বলে উঠলেন আমাকে ছেড়ে যেওনা। মনে হয় চাচা আপন জান বাঁচা। লোক হেঁটে যাচ্ছে সবার মনেই আতঙ্ক । “সেই দিনের দুঘন্টা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি”।
সেই দুঘন্টা এক স্মৃতিময়। যা কোনদিন ভুলা যাবে না।
পরের দিন লন্ডনের ফ্লাইট। আগেই বলেছি হজ্জ পালন শেষে বাংলাদেশ এবং পরে আবার লন্ডন। টেলিভিশনে খবর শুনলেই মন আৎকে উঠে।দেশের ছাত্ররা একের পর এক জীবন দিচ্ছে। কি হবে কেউ জানে না। আবার দেখতে পাচ্ছি ছাত্রদের সাথে অভিভাবকরাও মাঠে নেমে পড়েছেন। আন্দোলন বেগবান হচ্ছে।
আমার টেনশন অন্যদিকে। ফ্লাইট ক্যানসেল হচ্ছে কি না? সন্তানের রেখে প্রায় দুই মাস বাইরে। যে করেই হোক লন্ডন তো যেতে হবে। ১৯ তারিখে সৌদি থেকে ঢাকায়। ২১ তারিখ ভোররাতে ফ্লাইট।যোগাযোগের কোন ব্যবস্থা নেই। টিভি তে দেখি একের পর এক ফ্লাইট বন্ধ।
আমি কিন্তু হতাশ বা নিরাশা কখনো হইনা। আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা নিতেই এয়ারপোর্টে এলাম। ঐ যে বললাম কারফিউ। কারফিউ এর মধ্যেই এয়ারপোর্টে যেতে হবে কোন গাড়ি নেই। যাতায়াতের কোন ব্যাবস্থা নাই। ভাগ্য ভালো য়ে এয়ারপোর্টের সেই নাম্বারে দিনের শুরুতেই ফোন দিলাম ভাই আপনার সাহায্যের দরকার অপর প্রান্ত থেকে বললেন কি করতে হবে বলেন আমি বললাম এখন তো কারফিউ চলছে কিন্তু আপনি আমাকে একটি গাড়ি পাঠাতে হবে? তিনি বললেন কোথায়? আমি বললাম নিকুন্জ-২ তখন বললেন আপনি রেডি থাকবেন গাড়ি চলে আসবে। রাতে রেডি হয়ে ফোন দিলাম গাড়ি আসলো আমরা এয়ারপোর্টে এলাম।
কি হবে আমরা কেউ জানি না? তবে ভাগ্য ভালো আমাদের ফ্লাইট পরিবর্তন হয় নাই। বিমানবন্দরে থমথমে ভাব কি হবে কেউ জান্ না আগের দুইদনের বিমানযাত্রীরা এদিক সেদিক ছুটে চলেছে কেউ তাদের সঠিক উত্তর দিতে পারছে না কারন তখনো বাংলাদেশের সব খানে ইন্টারনেট নেই।
আমরা কোনরকম মালামাল বুকিং দিয়ে বর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মজিব কর্নার দেখলাম। তার পাশেই পর্যটনের শো রুম। এরই পাশে স্নাক্সের দোকান সেখান থেকে দুইজন দুইটি ছোট্ট মাটির কাপের দৈ খেয়ে অনেক তৃপ্তি পেলাম। ক্লান্তি এবং দূঃশ্চিন্তা মিনিশেই উড়ে গেলো। এরপর ১০নং গেইটে আমাদের ফ্লাইট অপেক্ষাকৃত। ফ্লাইট উঠে সেই যে শান্তি। চলে এলাম একটি বাংলাদেশের ক্লান্তি কাল থেকে।প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের এখনো মনের গহীনে আছে এবং রবে চিরকাল।